গর্ভাবস্থায় ম্যালেরিয়ার ওষুধ খাওয়া যায় কি?

গর্ভাবস্থায় ম্যালেরিয়ার ওষুধ খাওয়া যায়?
অধ্যাপক (ডাঃ) অমিতাভ নন্দী

❏ প্রশ্ন: মশা যেখানে বেশি থাকে সেখানে ম্যালেরিয়া কম হয়?

☛ উত্তর: কথাটা কিছুটা সত্যি। কারণ মশা বেশি হয় যেখানে পচা ডােবা, খােলা নর্দমা ইত্যাদি বেশি থাকে। ম্যালেরিয়ার মশা নােংরা জলে জন্মায় না। অতএব এই সমস্ত এলাকায় ম্যালেরিয়া হওয়ার সম্ভাবনা একটু কম। তবে সেখানেও পরিষ্কার জমা জলে ম্যালেরিয়ার মশা জন্মাতে পারে এবং অন্য জায়গা থেকে কেউ রােগ নিয়ে এসে উপস্থিত হলে রােগ ছড়াতে পারে। তা হলেও ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকার তুলনায় সংখ্যাটা কমই হবে।

❏ প্রশ্ন: নার্সিংহােম বা হাসপাতালে যেখানে ম্যালেরিয়া ওয়ার্ড নেই, সাধারণ রােগীর পাশে মালেরিয়া রােগী রাখলে কি রােগ ছড়াতে পারে?

☛ উত্তর: ম্যালেরিয়া ঘেঁয়াচে নয়। এর ছড়ানাের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম ভাবে হয়। ম্যালেরিয়া হওয়ার ৪-৬ দিন পর মশা কামড়ালে মশার শরীরে ম্যালেরিয়ার জীবাণু যায়। চিকিৎসা শুরু হয়ে গেলে সে সম্ভাবনাও কমে যায় অনেকখানি। তার ৭-১০ দিন পরে সেই মশা সুস্থ মানুষকে সংক্রামিত করতে পারে ' ম্যালেরিয়ার মশা কামড়ালেই ম্যালেরিয়া হবে তা নয়। মানুষটির রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা জোরদার হলে হবে না। হলেও রােগ দেখা দিতে দিতে ১৬ সপ্তাহ সময় লেগে যাবে। অতএব নার্সিংহােম বা হাসপাতালে এসে ম্যালেরিয়া হয়েছে মানে রােগ সেখান থেকেই ছড়িয়েছে সব সময় এরকম নাও হতে পারে। তা সত্ত্বেও নার্সিংহােম, হাসপাতাল মশামুক্ত রাখা এবং ম্যালেরিয়া রােগীকে সন্ধ্যের পর থেকে মশারির নীচে রাখা দরকার। আলাদা ম্যালেরিয়া ওয়ার্ডের কোনও প্রয়ােজন নেই।

❏ প্রশ্ন: কী সাবধানতা মেনে চললে ম্যালেরিয়া প্রতিরােধ করা যাবে?

☛ উত্তর: সে তাে সবাই জানে এখন। বাড়ির চারপাশে জল জমতে না দেওয়া। চৌবাচ্চা থাকলে ৭ দিনে অন্তত একবার শুকিয়ে নেওয়া। সন্ধে হতেই ঘরে মশার ধূপ জ্বেলে দেওয়া। দরজা জানলা বন্ধ রাখা বা জাল লাগানাে। মশারির নীচে শােয়া এবং খেয়াল রাখা শরীরের কোনও অংশ যাতে মশারির গায়ে লেগে না থাকে এবং যে কোনও রকমের জ্বর হলে ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা করান।

❏ প্রশ্ন: মরসুম শুরু হওয়ামাত্র ক্লোরােকুইন খেতে শুরু করলেও তাে ম্যালেরিয়া প্রতিরােধ করা যায়?

☛ উত্তর: আগে থেকে ক্লোরােকুইন খেতে শুরু করলে ম্যালেরিয়ার তীব্রতা কমিয়ে রাখা যায়, প্রতিরােধ করা যায় না। এছাড়া এর কতগুলি খারাপ দিকও আছে। যেমন এদের ম্যালেরিয়া হলে প্রথমদিকে উপসর্গ এবং রক্তে জীবাণু এত কম মাত্রায় থাকে যে রােগ ধরা পড়তে দেরি হয়। জীবাণু ক্লোরােকুইনের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ তৈরি করে। ফলে রােগ হলে এই ওষুধে আর কাজ হয় না এবং বেশি দিন ধরে ক্লোরােকুইন খেতে থাকলে চোখের ক্ষতি হয়।

❏ প্রশ্ন: কিন্তু জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়ার আগে তাে সাবধানতা হিসেবে ওষুধ খেতে বলা হয়?

☛ উত্তর: না, খেতে বলা হয় না। জঙ্গল এবং প্রতিরােধী ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা যেমন, ওড়িষ্যা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরবঙ্গ ইত্যাদি জায়গায় বেড়াতে গেলে এবং সেখানে যদি ৭ দিনের বেশি থাকার কথা থাকে, সাবধানতা হিসাবে সঙ্গে মেলােকুইন অথবা কুইনাইন নিয়ে যেতে বলা হয়। পৌছনাের ৭-৮ দিনের মাথায় জ্বর হলে প্রতি কেজি ওজনের জন্য ১৫ মিলিগ্রাম মেলােকুইন খেতে হয়। অথবা হিসেবে মতাে কুইনাইন। অবশ্য রক্ত পরীক্ষা করার সুবিধে থাকলে আগে পরীক্ষা করে নিয়ে তবেই ওষুধ খাওয়া উচিত।

❏ প্রশ্ন: মেলােকুইন বেশি দিন ধরে খেলে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে?

☛ উত্তর: শুধু মানসিক সমস্যা নয়, হার্ট এবং কিডনিও খারাপ হতে পারে। তবে ডাক্তাবেব পরামর্শ মতাে সঠিক মাত্রায় খেলে তেমন ভয়ের কিছু নেই। সামান্য সমস্যা দেখা দিলেও তা সহজ আয়ত্তে আনা যায়।

❏ প্রশ্ন: ম্যালেরিয়ার রক্ত পরীক্ষার সঠিক নিয়ম কী? জ্বর এবং কাপুনি থাকাকালীন রক্ত পরীক্ষা করালে ম্যালেরিয়ার জীবাণু ধরা পড়ে না।

☛ উত্তর: এরকম কোনও কথা নেই। যে কোনও অবস্থায় রক্ত পরীক্ষা করলেই জীবাণুর হদিশ পাওয়া যায়।

❏ প্রশ্ন: ম্যালেরিয়া হয়েছে অথচ রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ল না এরকমও তাে হয়?

☛ উত্তর: রােগ প্রাথমিক অবস্থায় থাকলে অনেক সময় রক্তে জীবাণুর সংখ্যা এত কম থাকে যে তা ধরা নাও পড়তে পারে, সেজন্য পরপর তিনদিন রক্তপরীক্ষা করার নিয়ম। ল্যাবরেটরির গােলযােগে কিছু ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে। আগে থেকে ম্যালেরিয়ার ওষুধ খেতে থাকলেও অনেক সময় জীবাণু ধরা পড়ে না।

❏ প্রশ্ন: এর ফলে রােগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যেতে পারে তাে?

☛ উত্তর: ৩ দিন পরপর রক্ত পরীক্ষা করিয়েও ম্যালেরিয়া ধরা পড়ল না, এরকম সম্ভাবনা খুব কম। তাছাড়া পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে ম্যালেরিয়া জটিল হতে ৫-৭ দিন সময় লাগে। তার মধ্যে রােগনির্ণয় এবং চিকিৎসা শুরু হয়ে যায়। বিপদ হয় শিশু, গর্ভবতী মহিলা, অসুস্থ এবং বয়স্ক মানুষের বেলায়। এদের ক্ষেত্রে রােগ শুরু হওয়ার ২-৩ দিনের মধ্যে অবস্থা খারাপ হয়ে যেতে পারে। কাজেই রােগ ধরা পড়ছে না অথচ প্রাথমিক উপসর্গে কিছু পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে এরকম অবস্থা হলে রােগ ধরা পড়ুক বা না পড়ুক ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা চালু করে দেওয়া দরকার।

❏ প্রশ্ন: প্রাথমিক উপসর্গ মানে তাে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা?

☛ উত্তর: সব সময় কাপুনি থাকে না। জ্বরের ধরনেও রকম ফের হয়। কারাের ক্ষেত্রে খুব বেশি, কারাের ক্ষেত্রে ঘুসঘুসে। জ্বর দিনের মধ্যে দু - লি বার বাড়তে কমতে পারে। কখনও এক দু দিন বাদে বাদে জ্বর আসে। বমি বমি ভাব বা বমি, মাথা ব্যথা ইত্যাদিও থাকতে পারে।

❏ প্রশ্ন: কী করে বােঝা যাবে রােগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে?

☛ উত্তর: বেশ কিছু লক্ষণ আছে, তার মধ্যে একটিও যদি কারাের মধ্যে দেখা যায় বুঝতে হবে রােগীর অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে।

যেমন:
( ১ ) খুব বেশি জ্বর ১০৫-১০৬° কি তারও বেশি।
( ২ ) রক্তে জীবাণুর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকা।
( ৩ ) প্রস্রাবের পরিমাণ কমে আসা বা বন্ধ হয়ে যাওয়া, হলুদ বা চায়ের লিকারের মতাে রংয়ের প্রস্রাব হওয়া।
( ৪ ) রক্তে হিমােগ্লোবিনের পরিমাণ ৭ গ্রামের নীচে নেমে যাওয়া।
( ৫ ) শরীরের কোথাও রক্তপাত, যেমন দাঁতে, চোখে, প্রস্রাবে, পায়খানায় বা কাশির সাথে।
( ৬ ) শ্বাসকষ্ট।
( ৭ ) হঠাৎ করে ঘাম দেওয়া বা হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া।
( ৮ ) রক্ত চাপ কমতে থাকা, নাড়ির গতি ক্ষীণ হয়ে আসা।
( ৯ ) অত্যধিক বমি।
( ১০ ) ভুল বকা।
( ১১ ) তরকা।
( ১২ ) অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

❏ প্রশ্ন: ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতেই কি রােগীর অবস্থা খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি?

☛ উত্তর: হ্যা।

❏ প্রশ্ন: মালিগন্যান্ট এবং সাধারণ ম্যালেরিয়া একসঙ্গে থাকলে কি অবস্থা আরও জটিল হয়?

☛ উত্তর: দু'ধরনের ম্যালেরিয়া একসঙ্গে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। থাকলে চিকিৎসা করা একটু জটিল হয়ে পড়ে।

❏ প্রশ্ন: ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হলেই কি সঙ্গে সঙ্গে রােগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার?

☛ উত্তর: না। তবে জটিলতা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করা উচিত।

❏ প্রশ্ন: ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় তাে মৃত্যুর হার খুব বেশি। তা কি অবস্থা জটিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেওয়া হয় না বলে?

☛ উত্তর: সেটা একটা বড় কারণ। এছাড়া রক্তে ফ্যালসিফেরাম জীবাণুর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে শুরু করলে শরীরের প্রায় প্রতিটি প্রত্যঙ্গে তার প্রভাব পড়ে। অনেক সময় পুরাে ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে যায় যে চিকিৎসা সত্ত্বেও রােগীর মৃত্যু এড়ানাে যায় না।

❏ প্রশ্ন: রক্তে জীবাণুর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, সেটা কীভাবে বােঝা যাবে?

☛ উত্তর: রক্ত পরীক্ষা করে। তবে এই পরীক্ষা সব জায়গায় হয় না। স্কুল অব ট্রপিকাল মেডিসিন এবং সেন্টার ফর ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড প্যারাসাইটোলজি থেকে করতে হবে।

❏ প্রশ্ন: গর্ভাবস্থায় ম্যালেরিয়ার ওষুধ খেলে গর্ভপাত হয়ে যায়?

☛ উত্তর: গর্ভাবস্থায় ক্ষতি হতে পারে প্রাইমাকুইন, সালফাডক্সিন, পাইরিমিথামিন, মেফললাকুইন, আরটিমিসিনিন, টেট্রাসাইক্লিন, ডক্সিসাইক্লিন ইত্যাদি ওষুধ খেলে, কিন্তু কুইনিন বা ক্লোরােকুইন স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করা যায়। এ নিয়ে দোনামনা করলে বরং বিপদের সম্ভাবনা বেশি। ম্যালেরিয়া হলে গর্ভবতী মায়ের অনেকসময় পেটে ব্যথা হয়। কিন্তু সেটা ওষুধের জন্য নয়, ম্যালেরিয়ার জন্য।

Previous Next
No Comments
Add Comment
comment url