মন্ত্র-তন্ত্র-যন্ত্র সম্পর্কে কিছু সংক্ষিপ্ত ধারণা

মন্ত্র-তন্ত্র-যন্ত্র সম্পর্কে কিছু সংক্ষিপ্ত ধারণা নিম্নে দেয়া হলো।

মন্ত্র:

কিছু বিশেষ বিশেষ অক্ষর ও শব্দের এমনিই সংগঠন আছে, যাকে বারবার উচ্চারণ করলে তার সংঘর্ষণে আবহাওয়ায় একটা বিশেষ প্রকার বিদ্যুৎ তরঙ্গ উৎপন্ন হয়ে সাধকের ঈপ্সিত ভাবনা-চিন্তাকে অভীষ্ট উদ্দেশ্য পুষ্ট করতে থাকে। এই হলাে মন্ত্র । আবহাওয়াকে আন্দোলিতকারী এই ক্রিয়া অন্ততঃ সাধককে ইচ্ছাপূরণের উপকরণ প্রস্তুত করে দেয়। প্রকারান্তরে বলা যায় যে, প্রবল ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে মানুষ কিছু প্রাপ্ত হতে পারে ও দৃঢ়-ইচ্ছাশক্তি নির্মাণে তাকে পােষণ করতে মন্ত্র সাধনা প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে। এইভাবেই মন্ত্র-শক্তির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

যন্ত্র:

তন্ত্র-সাধনার এই পদ্ধতি কোনও ভৌতিক (পদার্থবাদী) মাধ্যমেও সম্বন্ধ থাকে। যখন মন্ত্র-সাধনায় শুধুমাত্র জপ করতে হয়, যন্ত্র সাধনায় মন্ত্র জপের সঙ্গে কিছু চিত্রাত্মক মাধ্যম ব্যবহার করা হয়। বিশেষ প্রকার চিত্র রেখা, বিন্দু, অঙ্ক এবং শব্দ সংযোজিত করে ধাতুর পাত,  ভূর্জপত্র অথবা অন্য কোন অন্য কোন বস্তুর উপর যন্ত্র লেখা হয়।

তন্ত্র:

বাস্তবিক পক্ষে ব্যবহারিক বিষয়। উপরােক্ত প্রকার যন্ত্র এবং মন্ত্রের প্রভাব। এতেও পাওয়া যায়। কিন্তু এর তৃতীয় আয়াস বিশুদ্ধ ভৌতিক পদার্থবাদী। অধ্যাত্ম অনুভবের বিষয়। যেমন- তান্ত্রিক মাধ্যম দৃষ্ট জগতের বস্তুগুলি। পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। যদিও মন্ত্রের প্রয়ােগ এর কিছু কিছু সিদ্ধান্তে অপরিহার্য। কিন্তু। এমন কিছু প্রয়ােগও আছে যাতে বিশুদ্ধ পদার্থবাদী সাধনা করা যায়। এই দৃষ্টিকোণ। থেকে তন্ত্রবিদ্যাকে আয়ুর্বেদ ও রসায়ন শাস্ত্রের জননী বলা যায়।।

আবির্ভাব
প্রায় সবার ধারণা যে, বেদের সরলীকরণ ‘উপনিষদ’-এর রূপে হয়েছে। তারপরে ‘পুরাণ’ এবং তারপরে ‘তন্ত্র' রূপে এসেছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে খ্রীষ্টাব্দ আরম্ভ হওয়ার দু'হাজার বছর পূর্ব থেকেই তন্ত্র-গ্রন্থগুলির রচনা শুরু হয়েছিল। আজ থেকে ১৫০০ হাজার বছর পূর্বে তন্ত্রবিদ্যা শুধুমাত্র ভারতেই নয়, তিব্বত, চীন, থাইল্যাণ্ড, কাম্বোজ ও মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত প্রসারিত হয় বা ছড়িয়ে পড়ে। বৌদ্ধ যুগে তন্ত্রের প্রভাব এতো তীব্রতর হয়েছিল যে, বৌদ্ধ সংস্কৃতিকে সকলে তন্ত্র-সংস্কৃতির পর্যায়ে এনেছিল।

ব্যাপক ক্ষেত্র— তন্ত্র-বিদ্যার ক্ষেত্র সুদূর প্রসারিত। নিম্নলিখিত বিষয়গুলি সবই তন্ত্রের মধ্যে পড়ে। যেমন— সৃষ্টি, প্রলয়, মন্ত্র সাধনা, দেবলোক, তীর্থ, চার-আশ্রম, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র আদি চারবর্ণ, যন্ত্র-বিদ্যা, কল্প বর্ণন, জ্যোতিষ, পুরাণ, ব্রত-উপবাস, নিত্যকর্ম, সমাজ-সেবা, রাজনীতি, দেহ-বিজ্ঞান, নারী-পুরুষের সম্বন্ধ, দান-পুণ্য, সাংসারিকতা (লোকাচার) এবং আধ্যাত্মিকতা। এখান থেকে শুরু করে যোগসাধনা সহ মোক্ষপ্রাপ্তি পর্যন্ত।

তন্ত্র-শক্তি প্রণেতা ভগবান শিব– তন্ত্র শাস্ত্রের প্রণেতা স্বয়ং ভগবান শিব। কোনও না কোনও রূপে সমস্ত সম্প্রদায় এঁকে মান্য করে। এজন্যই সমস্ত তন্ত্র-সাধক ভগবান শিবকে নিজের আদিদেব স্বীকার করেন।

তন্ত্র সাহিত্য রচনা পরিমাণ দৃষ্টিতে আশ্চর্যজনক। দুঃখের বিষয় শতাধিক গ্রন্থ আজ পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র তার নামোল্লেখ পাওয়া যায়। বিদেশী আক্রমণে ভারতের সংস্কৃতি ও শ্রীকে ছিন্ন করার জন্য ‘গ্রন্থনাশ’ করার সুযোগ নেয়। তার ফলে অনেক দুর্লভ পাণ্ডুলিপি বিদেশী আক্রমণের দ্বারা ভস্মীভূত হয়ে যায়।

তন্ত্র সাহিত্যের গ্রন্থরূপ অনেক পরে পাওয়া যায়। কয়েক শতাব্দী যাবৎ এটি গুরু-শিষ্যের মাধ্যমে ভৌতিক শিক্ষণ ও স্মৃতি সংরক্ষণ রূপে চলেছিল। পরে ভূর্জপত্র, তালপত্র, তামার পাত, অথবা কোনও বস্তুর ওপর লিখে স্মরণীয় করে রাখা হয়েছিল।

কাগজের আবিষ্কার হয় এর অনেক পরে। তখন শুধুমাত্র হাতের লেখাই প্রচলিত ছিল। মুদ্রণ যন্ত্র তো মাত্র সেদিন তৈরী হয়েছে। অর্থাৎ যখন লিখে রাখা হতো, তার হাজার বছর পরে। 

সুলভ ও দুর্লভ গ্রন্থ – তন্ত্র সাহিত্যের গ্রন্থগুলিকে গণনা করে সূচী তৈরী করা সহজ বা সম্ভব নয়। কিন্তু দু'চারটি নাম এতো বিখ্যাত যে, তার দ্বারা তন্ত্র সম্বন্ধে অনেক কিছুই লেখা যায়। এখানে বিখ্যাত কয়েকখানি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হলো।

১। মহাসিদ্ধসার তন্ত্র
২। কুলার্ণব তন্ত্র
৩। বারাহী তন্ত্র
৪। রুদ্রযামল তন্ত্র
৫। শক্তিমঙ্গল তন্ত্র
৬। আগমতত্ত্ব বিলাস
৭। তন্ত্র সার 
৮। শারদা তিলক
৯। প্রমোদ মহাযুগ
১০। শঙ্কর তন্ত্র
১১। আগম দ্বৈত নির্ণয় ইত্যাদি।

সংক্ষেপে তন্ত্র সাহিত্যের বিশালতার অনুমান এই তথ্য দ্বারাই হয়ে থাকে যে, বিভিন্ন সম্প্রদায়গুলির অন্তর্গত তন্ত্র-গ্রন্থগুলির সংখ্যা নিম্নলিখিতভাবে বলা যায়। যেমন—

বিষ্ণুক্রান্তা— ৬৪ তন্ত্র
রথক্রান্তা— ৬৪ তন্ত্র
অশ্বক্রান্তা— ৬৪ তন্ত্র
শিব বর্ণিত— ২৩ তন্ত্র
মূলতন্ত্র বর্ণিত— ৬৪ তন্ত্র
অন্য সাক্ষ্য দ্বারা প্রাপ্ত— ৬৪ তন্ত্র
বৌদ্ধ সাহিত্য— ৫৫ তন্ত্র
সংকলন গ্রন্থ— ১৬ খানির বেশী

এই প্রকার প্রায় ৫০০ শত তন্ত্র গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়।
Previous Next
No Comments
Add Comment
comment url