কিডনি সুস্থ রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু ডাক্তারি পরামর্শ

মাথা ব্যথার ওষুধ নিয়মিত খেলে নাকি কিডনি খারাপ হয়ে যায়? শুধু মাথা ব্যথার ওষুধ কেন, অজস্র ওষুধ আছে যাদের লাগাম ছাড়া ব্যবহারে কিডনির ক্ষতি হতে পারে। যেমন, ফেনসিটিন, ব্রুফেন, ভােভেরান জাতীয় ব্যথার ওষুধ, অ্যান্টিবায়ােটিকের মধ্যে স্ট্রেপ্টোমাইসিন, জেন্টামাইসিন ইত্যাদি। সিটিস্ক্যান, অ্যাঞ্জিওগ্রাফি, আই ভি পি ইত্যাদি করার সময় শরীরে যে ডাই ইঞ্জেকশন দেওয়া হয় তাও অনেক সময় কিডনির পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। এ তাে কয়েকটা উদাহরণ দিলাম। আসল কথা হল যে কোনও ওষুধই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে খেয়ে গেলে বিপদের সম্ভাবনা থাকে। আরো জানাচ্ছেন, ডাঃ গৌতম মজুমদার

❍ প্রশ্ন: কিন্তু ব্যথার ওষুধ তাে আমরা আকছার খেয়ে থাকি।

☛ উত্তর: খাবেন না। রােগের চিকিৎসা করান। আর যদি খেতেই হয় প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খান। এটা ততটা ক্ষতিকর নয়। অন্তত এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি।

❍ প্রশ্ন: আর স্ট্রেপ্টোমাইসিন, জেন্টামাইসিন? এতাে খুবই চালু অ্যান্টিবায়ােটিক?

☛ উত্তর: সে তাে বটেই। এবং উপকারীও। আসলে কী জানেন, কোনও বিশেষ রােগীর ওপর আমবা যখন কোনও ওষুধ প্রয়ােগ করি, অনেক অগ্রপশ্চাৎ ভেবে করি। সমস্যা হয় তখন, যখন রােগী নিজের ওপর সেই বিচারের ভার তুলে নেন। পুরনো প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে ওষুধ কেনা, হাঁচি কাশিতে অ্যান্টিবায়ােটিক কিনে খেয়ে নেওয়া - বিপদ আসে এসব ক্ষেত্রে। কাজেই অযথা ভয় পাবেন না। শুধুমাত্র কথায় কথায় ওষুধ খাওয়ার অভ্যেস ত্যাগ করুন। শরীর খারাপ হলে ডাক্তার দেখান। তারপর তাঁর কথা অনুযায়ী ওষুধ খান।

❍ প্রশ্ন: চুলকুনি (স্ক্যাবিজ) হলে নাকি ভবিষ্যতে কিডনি খারাপ হয়ে যায়?

☛ উত্তর: সম্ভাবনা আছে। এবং আমাদের দেশে এর প্রকোপ খুব কম নয়। চুলকুনি হল, চিকিৎসা হল, সেরে গেল তাহলে তেমন সমস্যা নেই। কিন্তু পুষে রাখলে চুলকুনির জায়গায় স্ট্রেপ্টোকক্কাস সংক্রমণ হতে পারে। এ থেকে অ্যাকিউট নেফ্রাইটিস হয়ে কিডনি সাময়িকভাবে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু চিকিৎসা করালে শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে কিডনি ঠিক হয়ে যায়।

❍ প্রশ্ন: টনসিলাইটিস পুষে রাখলেও তাে কিডনি খারাপ হয় শুনেছি?

☛ উত্তর: টনসিলাইটিস বা ফ্যারিনজাইটিস বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের দরুন হয়। সংক্রমণের কারণটি যদি হয় স্ট্রেপ্টোকক্কাস, এবং তার সঠিক চিকিৎসা না হয়, অ্যাকিউট নেফ্রাইটিস হওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। তবে আগেই বলেছি চিকিৎসায় শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে এই রােগ ভাল হয়ে যায়।

❍ প্রশ্ন: নেফ্রাইটিস হয়েছে কীভাবে বােঝা যাবে?

☛ উত্তর: নানারকম উপসর্গ নিয়ে রােগী আসতে পারেন। প্রথম দিকে গলা ব্যথা, অল্প জ্বর বা চামড়ায় ঘা থাকতে পারে। ঠিকমতাে চিকিৎসা না হলে রােগ ছড়িয়ে পড়ে শরীরে। মুখ, শরীর ফুলে যায়, প্রস্রাব কমে যায়, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত আসতে পারে, রক্তচাপ বেড়ে যায়। প্রস্রাব বন্ধও হয়ে যায় কখনও কখনও। তবে অনেক সময়ই উপসর্গ সে রকম মারাত্মক না হওয়ার দরুন, রােগ ধরা পড়ে দেরিতে। এমনকি কিডনি খারাপ হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ধরা পড়ে না এমনও হয়।

❍ প্রশ্ন: যথাযথ চিকিৎসা হলে তাে আর কিডনি নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে না?

☛ উত্তর: নেফ্রাইটিস দু' ধরনের— অ্যাকিউট এবং ক্রনিক। অ্যাকিউট নেফ্রাইটিস বেশি হয় বাচ্চাদের। ২-৩ বছর বয়স থেকে ১৪-১৫ বছর বয়স পর্যন্ত। এবং রােগ ধরা পড়ার পর ৪-৫ বছর ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থাকলে সম্পূর্ণ হয় চিকিৎসার পর্যায়। সঠিক চিকিৎসা হলে শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে বােগ ঠিক হয়ে যায়। সমস্যা হয় ক্রনিক নেফ্রাইটিসের বেলায়। এক্ষেত্রে অনেক সময়ই পুরােপুরি সুস্থতা ফিরিয়ে দেওয়া যায় না।

❍ প্রশ্ন: হাম সেরে যাওয়ার পর কিডনির অসুখ হতে পারে?

☛ উত্তর: হাম, বসন্ত, ভাইরাল ফিভার এবং আরও বশ কিছু সংক্রামক অসুখের পর অ্যাকিউট নেফ্রাইটিস হতে পারে।

❍ প্রশ্ন: আন্ত্রিক থেকেও কিডনি খারাপ হয়?

☛ উত্তর: ঠিক সময় চিকিৎসা না হলে হতে পারে।

❍ প্রশ্ন: কেন?

☛ উত্তর: আন্ত্রিক জাতীয় অসুখে বারবার বমি পায়খানার দরুন শরীরে জলের ভাগ দ্রুত কমে যেতে থাকে। ফলে রক্ত ভারী হতে শুরু করে। রক্তচাপ কমতে থাকে। কমচাপে ভারী রক্ত স্বাভাবিকভাবেই প্রয়ােজনের তুলনায় কম পরিমাণে কিডনির মধ্যে দিয়ে যায়। এবং একটা সময় আসে যখন রক্ত এত ভারী হয়ে যায় যে কিডনির মধ্যেকার সূক্ষ্ম নালিগুলির মধ্যে দিয়ে যাতায়াতই আর সম্ভব হয় না। ফলে কিডনি কমজোরি হতে হতে এক সময় সাময়িকভাবে খারাপ হয়ে যায়। অর্থাৎ অ্যাকিউট রেনাল ফেইলিওর দেখা দেয়।

❍ প্রশ্ন: ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াও তাে কিডনির ক্ষতি করে?

☛ উত্তর: হ্যাঁ, শতকরা ১০ ভাগ ফ্যালসিফেরাম ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রােগীর কিডনি খারাপ হতে পারে।

❍ প্রশ্ন: সাপে কাটা বা বিষ খাওয়া রােগীদের অনেক সময় ডায়ালিসিস করা হয়। এদেরও কি কিডনি খারাপ হয়ে যায়?

☛ উত্তর: বােড়া জাতীয় সাপ যেমন চন্দ্রবােড়ার বিষের প্রভাবে রক্ত ভেঙে যেতে শুরু করে এবং সেই ভেঙে যাওয়া রক্ত ছােট ছােট ডেলা পাকিয়ে বিভিন্ন সূক্ষ্ম রক্তবাহী শিরা উপশিরার মধ্যে জমা হতে শুরু করে। যথারীতি কিডনির মধ্যেও একই ব্যাপার ঘটে। এবং কিডনি কমজোরি হয়ে পড়ে। অ্যান্টিভেনােম ইনজেকশন দিয়ে তাড়াতাড়ি ডায়ালিসিস শুরু করলে রােগীকে বাঁচানাে যায়। বিষক্রিয়ার মধ্যে সবথেকে মারাত্মক হল কুঁতে এবং পারদ। এরা সরাসবি কিডনিকে আক্রমণ করে। বাকি ফলিডল, টিক-২০, উকুন মারার বিষ ইত্যাদির বিষক্রিয়ায় ডায়রিয়া হলে শরীরে জলশূন্যা দেখা দেয়। ফলে কিডনি খারাপ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।

❍ প্রশ্ন: অনেকে বলেন ছােটবেলায় ফাইনােসিস অপারেশন না করালে পরবর্তী কালে কিডনির ক্ষতি হয়?

☛ উত্তর: ফাইমােসিস অপারেশন প্রত্যেকের জন্য আবশ্যিক এরকম নয় ব্যাপারটা। তবে বাচ্চার যদি সমস্যা থাকে অপারেশন করিয়ে নেওয়া দরকার। না হলে খুব ধীরে ধীরে কিডনির ক্ষতি হতে পারে। যাকে ডাক্তারি ভাষায় আমরা বলি অবস্ট্রাকটিভ ইউরােপ্যাথি। এর ফলে পরবর্তী কালে ক্রনিক রেনাল ফেইলিওর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

❍ প্রশ্ন: বাচ্চার মধ্যে কী সমস্যা দেখলে বুঝব অপারেশন দরকার?

☛ উত্তর: প্রস্রাব হবে খুব সরু ধারায়। কখনও ফোঁটা ফোঁটা। প্রস্রাব করার সময় বাচ্চা কাঁদবে। এরকম উপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। ইউরেথ্রাল ভাল্ভ নামে আরেকটি রােগের ক্ষেত্রেও এই ধরনের উপসর্গ থাকে। তখনও সাবধানতা নেওয়া দরকার।

❍ প্রশ্ন: বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রেও তাে অনেক সময় এই ধরনের উপসর্গ দেখা যায়?

☛ উত্তর: হ্যাঁ, পুরুষ, মহিলা দুইয়ের ক্ষেত্রেই বেশি বয়সে এই জাত্রয় সমস্যা দেখা দিতে পারে। ছেলেদের প্রস্টেট বেড়ে গেলে অবস্ট্রাকটিভ ইউরােপ্যাথি হয়। মহিলাদের ক্ষেত্রে মেনােপজের পর সমস্যা বাড়ে।

❍ প্রশ্ন: সমাধানের রাস্তা কী?

☛ উত্তর: মহিলাদের ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেন হমমান ঘাটতি রয়েছে এর মূলে। স্ত্রীরােগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতাে হমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করালে ফল পাওয়া যাবে। আর ছেলেদের ক্ষেত্রে ইউরােলজিস্টের পরামর্শ মতাে প্রস্টেটের চিকিৎসা। দরকার হলে অপারেশন।

❍ প্রশ্ন: কিডনি সুস্থ রাখতে গেলে কী কী সাবধান মেনে চলতে হবে?

☛ উত্তর: আকস্মিক অঘটনের ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিলে অ্যাকিউট রেনাল ফেইলিওর এড়িয়ে যাওয়া যায়। সমস্যা দেখা দেয় ক্রনিক রেনাল ফেইলিওয়ের বেলায়। বেশ কিছু লােগ, কিছু ওষুধ এবং ত্রুটিপূর্ণ জীবনযাত্রার দরুণ অনেক সময়ই ধীরে ধীরে জখম হতে থাকে কিডনি। প্রথম দিকে উপসর্গ তেমন কিছু মারাত্মক না থাকায় ব্যাপারটা গুরুত্ব পায় না। প্রায় সময়ই রােগী আসেন খুবই সংকটজনক অবস্থায়। কিডনির কার্যক্ষমতা যখন শতকরা ১০ ভাগের নীচে। অর্থাৎ এ স্টেজ রেনাল ডিজিজ। এই অবস্থা এড়াতে কয়েকটি জিনিস বিশেষভাবে খেয়াল রাখুন।
(১) অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ৪-৫ বছরের মধ্যে বিপদে ফেলে দিতে পারে। নিয়মিত ব্লাডসুগার পরীক্ষা করান। ওষুধপত্র এবং খাওয়া দাওয়ার নিয়ম মেনে চলুন।
(২) কিডনির আরেক শত্ৰু উচ্চ রক্তচাপ। এক্ষেত্রেও একই কথা। ওষুধপত্র এবং খাওয়া দাওয়ার নিয়ম কানুন মেনে চলা দরকার।
(৩) প্রস্রাব বারবার সংক্রমণ হতে থাকলে পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে জেনে নিন এটি সাধারণ সংক্রমণ না এর পেছনে পাথব, রিফ্লা ’ বা টিবি লুকিয়ে আছে কিনা।
(৪) নিজে নিজে ওষুধ খাবেন না। যেকোনও অসুখেই ডাক্তার দেখিয়ে, রােগ নির্ণয় করে সঠিক ওষুধ খান।
(৫) ধূমপান, মদ্যপানে কিডনির সরাসরি ক্ষতি নেই। তবে এর ফলে রক্তচাপ এবং রক্তে কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বাড়লে কিডনির ক্ষতি হতে পারে।
(৬) সাধারণ স্বাস্থ্য ভাল রাখুন এবং খাওয়া - দাওয়ার দিকে নজর দিন।

❍ প্রশ্ন: কিডনি ভাল রাখতে কী খাব আর কী খাব না?

☛ উত্তর: প্রচুর জল খেতে হবে। ওজন এবং জীবিকার ওপর নির্ভর করে দিনে কম করে ২-৩ লিটার জল খাওয়া দরকার। সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে খাওয়ার তেমন বিধি নিষেধ নেই। তবে খাওয়া থেকে যাতে সংমণ না হয় সেদিকে নজর রাখা উচিত। বিশেষ রােগের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে।
(১) ডায়াবেটিস থাকলে মিষ্টি একদম বন্ধ। চিনি, গুড়, পাকা ফল ইত্যাদি খাবেন না।
(2) উচ্চরক্তচাপের রােগী ভাজাভুজি, পাঠার মাংস, তৈলাক্ত খাবার বা কাঁচা নুন যথাসম্ভব কম খাবে।
(৩) গেঁটেবাতের রোগ হলে এড়িয়ে চলবেন পাঠার মাংস, ডিম, তৈলাক্ত মাছ, মাছের ডিম, দুধ বা দুধজাতীয় খাবার।
(৪) কিডনিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা থাকলে দুধ, ছানা, ডিম, তৈলাক্ত মাছ, কুচো মাছ, মাছের মাথা, মাংসের হাড়, পাঁঠার মাংস, পালং শাক, শুকনাে ফল, যেমন কাজু, কিশমিশ ইত্যাদি কম খেতে হবে।

❍ প্রশ্ন: আর জীবনযাত্রা?

☛ উত্তর: কিডনি সুস্থ রাখতে তেষ্টা পেলেই জল খেতে হবে আর ৪-৫ ঘন্টা বাদে বাদে বাথরুম যেতে হবে। কারণ প্রান্তে বেগ চেপে রাখলে পরবর্তীকালে সমস্যা দেখা দিতে পার। কিছু কিডনির অসুখ যেমন, পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ বংশানুক্রমে বাহিত হয়। এর ফলে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারাের এই অসুখ থাকলে সন্তানের জন্ম দেওয়ার আগে জেনেটিক কাউন্সেলিং অথবা অ্যামনিওসিস্টেসিস করে জেনে নেওয়া দরকার সন্তানের রােগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা। বংশে কারাের যদি কিডনির অসুখ থাকে বা আপনার হওয়ার সম্ভানা আছে বলে বােঝেন, আগে থেকে স্বাস্থ্যবীমা করিয়ে নিতে হবে। কারণ রেনাল ফেইলিওয়ের চিকিৎসা খুবই ব্যয় বহুল।

Previous Next
No Comments
Add Comment
comment url