অর্থসহ খনার বচন সমূহ

খনার সংক্ষিপ্ত জীবনী

খনার জীবন বৃত্তান্ত সম্বন্ধে অনেক প্রবাদ আছে। অনেকে বলেন খনার পিতা লঙ্কাবাসি ছিলেন। খনার বুদ্ধির তাৎপর্য দেখে তার পিতা তাকে জ্যোতিষ শাস্ত্র শিক্ষা দেয়। তৎকালে কিছু বছর আগে উজ্জয়িনীর মহারাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভায় বরাহ পণ্ডিতের এক পুত্র সন্তান হয়েছিল। জ্যোতিষ শাস্ত্রে পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও ভূলবশতঃ বরাহ পণ্ডিত পুত্রের আয়ু শত বর্ষের স্থলে মাত্র দশ বৎসর গণনা করেন। পুত্রকে লালন-পালন করে শােকগ্রস্ত হতে হবে ভাবিয়া তিনি সদ্যজাত পুত্রকে একটি তাম্র পাত্রে ভরিয়া সমুদ্রে ভাসাইয়া দেন। সেই তাম্রপাত্র সন্তান সহ ভাসিতে ভাসিতে লঙ্কার উপকূলে উপনীত হয় এবং খনার পিতার হাতে পড়ে! 

খনার বচন

তারপর, খনার সহিত মিহিরকে লালন-পালন করেন তারা এবং খনার সহিত তার বিবাহ দেন। এক সময় মিহির গণনার মাধ্যমে জানতে পারে যে, তার পিতা ‘বরাহ পন্ডিত। আশ্রয়ে থাকিতে ভালাে না লাগায় সুযোগ বুঝে মিহির ও খনা সেখান থেকে চলে আসেন উজ্জয়িনী নগরে। বরাহ পণ্ডিত পুত্রবধূ ও পুত্র পাইয়া অত্যন্ত আনন্দিত হয়। তাহাদের সুখ্যাতি ক্রমাগত চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। খনা মুখে যাহা বলিত উহা সত্য বলিয়া প্রমাণিত হইত। পুত্রবধূ খনার সুখ্যাতিতে শ্বশুর ও স্বামীর মন ম্লান হয়ে যায়। প্রবাদ আছে, স্বামী ও শ্বশুরের সুনাম অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য খনা স্বয়ং নিজের জিহ্বা নিজেই কর্তন করিয়াছিলেন।

অর্থসহ খনার বচন সমূহ:

[যাত্রাকালে শুভ-অশুভ নির্ণয়, শুভ ও অশুভের ফলাফল ইত্যাদি]

১।
শূন্য কলসী শুকনা না।
শুকনা ডালে ডাকে কা।
যদি দেখ মাকুন্দ চোপা।
এক পা না যেও বাপা।

যদি যাত্রাকালে শূন্য কলসী শুকনা নৌকা, শুকনা ডালে কাক ডাকিতে দেখাে; কিংবা দাড়ি গােফহীন মাকুন্দ লােককে দেখতে পাও, তাহলে যাত্রা করা উচিত নয়।

২।
খনা বলে এরেও ঠেলি।
যদি না দেখি সম্মুখে তেলি।

যাত্রাকালে সমস্ত বাধাই হয়তাে ঠেলা যায়, কিন্তু সামনে তেলীজাতের লােককে দেখলে কদাচ যাত্রা করিতে নাই। কারণ তাতে ফল ভালাে হয় না।

৩।
মঙ্গলের উষা বুধে পা।
যথা ইচ্ছা তথা যা ॥

মঙ্গলবারের রাত যখন ভাের হয় অর্থাৎ বুধের শুরুতেই যদি যাত্রা করা যায়, তাহলে সব কাজে সফল হওয়া যায়।

৪।
রবি গুরু মঙ্গলের উষা।
আর সব ফাস ফুসা।।

রবিবার, বৃহস্পতিবার আর মঙ্গলবারের উষায় যাত্রা করা শুভ। অন্যান্য দিন যাত্রা করলে শুভ ফল না পাওয়াই সম্ভব।

৫।
ডাকে পাখী না ছাড়ে বাসা।
উড়িয়ে বৈসে খাবে করি আশা।
ফিরে যায় বাসে না পায় দিশা।
খনা ডেকে বলে সেই সে উষা।
উড়ে পড়ে খায় না।
তখনই কেন যায় না।

রাতের পাখীরা যখন বাসার মধ্যে থাকে। বাসা ছেড়ে ওড়ার ইচ্ছে তবু উড়তে পারে না। বার বার দিশেহারা হয়ে | বাসাতেই ফিরে আসে। রাত্রি শেষের সেই সময়টাই উষাকা। সেই সময় যাত্রা করা সবচেয়ে ভাল।

৬।
দ্বাদশ অঙ্গুলি কাঠি।
সূর্যরদমণ্ডলে দিয়ে দিঠি।
রবি কুড়ি সােমে ষােল।
পঞ্চদশ মঙ্গলে ভালাে ৷
বুধে এগার, বৃহস্পতি বারাে,
শুক্র চৌদ্দ, শনি তেরাে।

ফাঁকা জায়গায় যেখানে সূর্যকিরণ পড়ে সেখানে বারাে আঙ্গুল মাপের একটা কাঠি পুতে দেখতে হবে, রােদে কতটা ছায়া পড়েছে। কুড়ি আঙ্গুল হলে রবিবারে, পনেরাে আঙ্গুল হলে মঙ্গলবারে, এগার আঙ্গুল হলে বুধবারে, বারো আঙ্গুল হলে | বৃহস্পতিবারে, চৌদ্দ আঙ্গুল হলে শুক্রবারে, তের আঙ্গুল হলে শনিবারে যাত্রা করিলে ভাল হয়।

৭।
হাঁচি জেটি পড়ে যবে।
অষ্টগুণ তার লভ্য না হবে।

যাত্রাকালে হাঁচি অথবা টিকটিকি পড়লে যাত্রা না করাই ভালো।

[শস্যাদি রােপণ, শস্যাদি গণনা, শস্য সাফল্য, শস্য কর্তন, আলি বন্ধন প্রণালী, হাল গণনা, কুয়াশা গণনা, ধান্য প্রভৃতি ফসল বিচার গণনা ইত্যাদি]

৮।
শ্রাবণের পুরাে ভাদ্রের বারাে।
এর মধ্যে যত পারো।

সম্পূর্ণ শ্রাবণ মাস ও ভাদ্র মাসের বারাে তারিখ পর্যন্ত রােপণের প্রশস্ত দিন।

৯।
ষােল চাষে মূলা। তার আধা তুলা।
তার আধা ধান। বিনা চাষে পান।

মূলার জন্য ষােলটি চাষ, তুলার জন্য আটটি চাষ, ধানের জন্য চারটি চাষের প্রয়ােজন। তাতেই ভাল ফসল পাওয়া যায়। পানের জন্য চাষের প্রয়োজন হয় না।

[হাল চালনার বিধি-নিষেধ]

১০।
খনা বলে হাল নিয়ে মাঠে যবে করিবে গমন।
আগে দেখে চাষী ভাই যেন হয় শুভক্ষণ ৷

শুভক্ষণ দেখে সদা করিবে যাত্রা। পথে যেন না হয় অশুভ বার্তা। হাল চালাতে যেতে হলে শুভ দিন দেখে হাল নিয়ে মাঠে যাওয়া উচিত। পথের মধ্যে যদি অশুভ সংবাদ পাওয়া যায় তাহলে মাঠে না গিয়ে বাড়ী ফিরে আসাই যুক্তিযুক্ত।

১১।
মাঠে গিয়ে আগে কর দিক নিরূপণ।
পূর্ব দিক হতে করহ হাল চালন।
খনা বলে মাের কথা শুন মহাশয়।
ফসল ফলিবে অধিক নাহি সংশয়।

মাঠে গিয়ে সবার আগে দিক নির্ণয় করে নিয়ে পূর্বদিক হতে হাল চালনা করতে হয়। যে তা করে সে অত্যধিক ফসল পায়।

১২।
অমাবস্যায় আর পূর্ণিমায় যেবা ধরে হাল,
তার দুঃখ থাকে চিরকাল।
তার বলদের হয় বাত, ঘরেতে না থাকে ভাত।
খনা বলে শােনরে বাণী, হাল ধরিবে দুঃখ গণি।

অমাবস্যা আর পূর্ণিমায় হাল ধরিতে নাই। যে ধরে তার দুঃখ চিরকাল বাঁধা থাকে। বলদ বাতে পঙ্গু হয়ে যায়। নানা কারণে তার চাষ নিষ্ফল হয়। ঘরে অন্নাভাব দেখা দেয়।

১৩।
আছে বলদ না করে চাষ
তার দুঃখ বারাে মাস।

ঘরে বলদ থাকতেও যে মায়া করে খাটায় না, তার বলদ শুধু বসে বসে খায়। তার জমিতে চাষ আবাদ হয় না। না হওয়ার দরুন ঘরে অন্নের অভাব হয়।

[ধান্য সম্বন্ধীয় চাষ]

১৪।
কোল পাতলা ডগার গুছি
লক্ষ্মী বলেন হেথায় আছি।

মােটা মােটা গুছি দিয়ে খুব ফাঁক ফাঁক করে ধান রােপণ করলে ধান বেশী পাওয়া যায়।

১৫।
আউশের চাষ, লাগে তিন মাস।।

রােপনের তিন মাসের মধ্যে আউশ ধান ঘরে তােলা হয়।

১৬।
আষাঢ়ে কাড়ান নামকে,
শ্রাবণে কাড়ান ধানকে।
ভাদ্রে কাড়ন শীষকে,
আশ্বিনে কাড়ান কিসকে।

আবাদের যােগ্য সময়কে কাড়ান বলে। বৃষ্টিপাত হলে ভূমিতে কাড়ানে পড়ে। আষাঢ়ে কাড়ান হলে জমিতে ভালাে ধান হয় না। শ্রাবণে কাড়ান হলে প্রচুর ধান ফলে। ভাদ্রের কাড়ন হলে শীষমাত্র সার হয়, আশ্বিনের কাড়ান একেবারেই নিষ্ফল, তাতে কোন ফল হয় না।

১৭।
বাড়ির কাছে ধান গা,
যার মার আছে ছা।
চিনিস বা না চিনিস,
খুঁজে দেখে গরু কিনিস।
চাল ধান দুই সস্তা—
মিষ্টি হবে লােকের কথা।

বাড়ীর কাছে যদি জমি থাকে, সবার আগে সেই জমিতেই চাষ আবাদ করা উচিত। তাতে চুরি যাবার ভয় থাকে না। গরু চেনার উপায় না থাক বা না থাক খুঁজে-দেখে গরু কেনা উচিত।

১৮।
আঁধার পরে তাদের কলা,
কতক কালে কতক ধলা।
উত্তর উঁচু দক্ষিণে কাত,
ধরায় ধানের বাত।
চাল ধান দুই সস্তা।
মিষ্টি হবে লােকের কথা।।

কৃষ্ণপক্ষের যে চাঁদ ওঠে তার কিছু অংশ আলাে আর বাকী অংশ আঁধারে আচ্ছন্ন থাকে। এই প্রতিপদ বা দ্বিতীয়া তিথিতে যদি উত্তরে উচু আর দক্ষিণে নিচু থাকে, তাহলে সে বছর প্রচুর ধান জন্মাবে। ধান চাল দুই-ই অত্যধিক সস্তা দামে পাওয়া যাবে। প্রচুর শস্য পেয়ে মানুষের আচার ব্যবহার মিষ্ট হবে।

১৯।
কার্তিকের জল উনো, ধান জন্মে দুনো।

কার্তিক মাসে যত অল্প জল হবে ধান গাছে তত বেশী ধান ফলবে।

২০।
বাধাে আগে আলি, রােও হবে শালি।
না যদি ফল ফলে, গালি পেড়ো খনা বলে।

জমিতে ভালােভাবে অল বেঁধে শালি ধানের চাষ করলে ফল ভালাে হয়। অন্যথায় কম।

২১।
আষাঢ়ের পঞ্চদিনে, রােপণ যে করে ধান।
বাড়ে তার কৃষিফল, কৃষিকার্যে হয় সফল।

আষাঢ়ের প্রথম পাঁচ দিনের মধ্যে যে চাষা ধান বপন করে। তার কৃষিকার্য সফল হয়। প্রচুর ধান পেয়ে থাকে সে।

২২।
বাপ বেটার চাষ চাই। তদ অভাবে সােদর ভাই।

পরের সাহায্যে যে কৃষক চাষ করে, তাহার লাভের আশা। আদৌ থাকে না। বাপ-বেটা কাজ করলে খুব ভালাে হয় তা নইলে সহােদর ভাইদের নেওয়া উচিত। অন্য কেউ তেমন করে খাটবে না।

২৩।
থােড় তিরিশে, ফুলে বিশে।
ঘােড়ামুখো তেরাে জেনাে, বুঝেসুঝে কাটো ধান।

থাের জন্মানাের ত্রিশ দিন পরে, ফুল বার হবার কুড়ি দিন। পরে, শীষ নতশির হওয়ার তেরাে দিন পরে ধান কাটতে হয়। অন্যথায় লাভের আশা থাকে না।

২৪।
শীষ দেখে বিশ দিন। কাটতে মাড়তে দশ দিন।

যে দিন ধানের শীষ বের হবে, তার বিশ দিন পরে কাটতে হবে। দশ দিন ধরে কাটাই ও মাড়াই কার্য সমাধা করে, ধান গোলায় তুলে রাখবে।

২৫।
অগ্রানে পউটী। পৌষে ছেউটী।
মাঘে নাড়া। ফাল্গুনে ফাড়া।।

অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটলে ষােল আনা ধান পাওয়া যায়। পৌষে কাটলে ছ আনা মাত্র পাওয়া যায়। মাঘে কাটলে খড় মাত্র অবশিষ্ট থাকে। ফাল্গুনে কাটলে কিছুই থাকে না।

২৬।
দিনে রােদ রাতে জল।
দিন দিন বাড়ে ধানের বল।

দিনে রােদ ও রাতে বৃষ্টি হলে ধানের গাছ খুব সবল হয়।

[ ধান ও পান চাষ ]

২৭।
এক অগ্রানে ধান। তিন শ্রাবণে পান।

এক অগ্রানেই ধান পাওয়া যায়। কিন্তু তিন শ্রাবণের কম পানের চাষ ঠিক হয় না।

২৮।
ডেকে ডেকে খনা গান।
রােদে ধান ছায়ায় পান।

রৌদ্রপূর্ণ জমিতে ধান, ছায়াপূর্ণ জমিতে পান চাষ করিতে হয়। তাতেই অধিক ফল পাওয়া যায়।

২৯।
পান পুতলে শ্রাবণে।
খেয়ে না ফুরায় রাবণে।

শ্রাবণ মাসে পান চাষ করিলে প্রচুর পান হয়। রাক্ষসের মত খেলেও তাহা ফুরায় না।

৩০।
চৈত্রের দশ বৈশাখের বার,
এর মধ্যে আউশ বপন কর।
বৈশাখের প্রথম জলে,
আউশ ধান দ্বিগুণ ফলে।

বৈশাখের প্রথমেই যদি ভালাে বৃষ্টি হয়, সে সময় আউশ ধানের চাষ করলে দ্বিগুণ ফল পাওয়া যায়।

[কলাই চাষ]

৩১।
ভাদ্রের চারি আশ্বিনের চারি,
কলাই বােনাে যত পারি।

ভাদ্র মাসের শেষ চারি দিন ও আশ্বিন মাসের প্রথম চারি দিন কলাই বােনার উপযুক্ত সময়।

[সরিষা চাষ]

৩২।
খনা বলে চাষার পাে,
শরতের শেষে সরিষা রাে।

শরৎকালের শেষে সরিষা বুনলে ভালাে সরিষা পাওয়া যায়। মটর কলাই চাষ।

৩৩।
আশ্বিনের উনিশ, কার্তিকের উনিশ,
বাদ দিয়ে মটর কলাই বুনিশ।

আশ্বির মাসের শেষ উনিশ দিন ও কার্তিক মাসের উনিশ দিন বাদ দিয়ে মটর কলাই বুনলে ফসল ভালাে হয়।

[সরিষা ও মুগ]

৩৪।
সরিষা বুনে কলাই মুগ,
বুনে বেড়াও চাপড়ে বুক।

একই জমিতে সরষে ও মুগ কলাই বুনতে হয়। তাহলে দুটি ফসলই এক সঙ্গে পাওয়া যায়। ইহা চাষীর আনন্দের কারণ স্বরূপ হয়।

[মান ও তিল চাষ] 

৩৫।
কোদালে মান তিলে হাল।
কাতেন ফাকরা মাঘের কাল।

মানের জমিতে কোদাল দিয়ে পাট করতে হয়। হাল চাষ ছাড়া তিল চাষ হয় না। শ্বেত তিল আশ্বিন-কার্তিকে বুনতে হয়। মাঘ ফাগুনে কালাে তিল চাষের উপযুক্ত সময়।

৩৬।
ফাল্গুনের আট চৈত্রের আট,
সেই তিল দায়ে কাট।

ফাগুন মাসের শেষ আটদিন ও চৈত্র মাসের প্রথম আটদিন তিল বােনার উপযুক্ত সময়।

[লাউ, লঙ্কা চাষ]

৩৭।
ছাইয়ে লাউ, উঠানে ঝাল।
কর বাপু চাষার ছাওয়াল।

ছাই মেশানাে মাটিতে লাউ গাছ ভাল হয়। পরে আবার তাতে ছাই দিলে লাউ ভালাে ফলে। উঠানে লঙ্কার চাষ করলে ফল ভালাে দেয়।

৩৮।
মাছের জলে লাউ বাড়ে।
ধেনাে জমিতে ঝাল বাড়ে।

লাউ গাছের পক্ষে মাছ ধােয়া জলই উপযুক্ত সার। ধানের জমিতে লঙ্কা চাষ করলে প্রচুর লঙ্কা পাওয়া যায়।

৩৯।
ভাদ্র আশ্বিনে না রুয়ে ঝাল,
যে চাষা ঘুমিয়ে কাটায় কাল।
পরেতে কার্তিক অগ্রান মাসে,
যদি বুড়াে গাছ ক্ষেতে পুঁতে আসে।
সে গাছ মরিবে ধরিবে ওলা, 
পাবে না ঝাল চাষার পোলা।।

ভাদ্র আশ্বিন মাসে লঙ্কা রােপণ করলে ফল ভাল হয়। তা না করে যদি আলস্যে সময় কাটিয়ে কার্তিক-অগ্ৰান মাসে রােপণ করা হয়- ধসা রােগে গাছ নষ্ট হয়। লঙ্কা পাবার কোন আশাই থাকে না।

[কলার চাষ]

৪০।
কি কর শ্বশুর খেটে খুটে,
ফাল্গুনে এঁটে পােত কেটে।
বেড়ে যাবে ঝাড়কে ঝাড়,
কলা আনিতে ভাঙ্গবে ঘাড়।

ফাল্গুন মাসে কলার এঁটে কেটে পুতে দিলে কলার ঝাড় খুব বাড়ে ও প্রচুর কলা ফলে থাকে।

৪১।
যদি পােত ফাগুনে কলা,
কলা হবে মাস ফসলা।

ফাগুন মাসে কলাগাছ পুতিলে প্রতি মাসেই কলা ফলে।

৪২।
ডাক দিয়ে বলে রাবণ,
কলা না লাগাবে আষাঢ়-শ্রাবণ।
তিনশত ষাট ঝাড় কলা রুয়ে।
থাক গৃহস্থ মাচায় শুয়ে।
লাগিয়ে গাছ কেটোনা পাত।
তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।

আষাঢ় শ্রাবণ মাসে কলাগাছ লাগালে গাছ ও ফল কোনটাই ভালাে হয় না। তিনশত ষাট ঝাড় কলাগাছ লাগিয়ে পাতা যদি না কাটা হয় সেই কলাগাছ হতে যে কলা ফলবে তাতেই সারা বছরের ভাত কাপড়ের খরচ চলে যাবে।

৪৩।
সাত হাতে তিন বিঘতে,
কলা লাগাবে মায়ে পুতে।

সাত হাত অন্তর অন্তর কলাগাছ পুঁততে হয়। মাটির নীচে দেড় হাত পরিমাণ গর্ত খুঁড়ে গাছ লাগানাে উচিত।

৪৪।
ভাদ্র মাসে রুয়ে কলা।
সবংশে মলাে রাবণ শালা।

ভাদ্র মাসে কলা রােপণ করবার জন্য রাবণ সবংশে ধ্বংস হয়। অতএব ঐ মাসে কলাগাছ না লাগানই ভালাে।

৪৫।
সিংহ মীনে বর্জ্জে, কলা যাবে আজ যে।।

ভাদ্র ও চৈত্র মাস বাদ দিয়ে কলাগাছ রােপণের উৎকৃষ্ট সময়, তাতেই ভালাে ফল হয়।

৪৬।
কলা তলায় যাবিনে, ফল তার খাবিনে।
লেগে যাবে ভুঁয়ে ভূঁয়ে। কলা যেন পুড়বে শুয়ে।

কলার মােচা না খাওয়াই ভালো। মােচা না কাটলে কলার ফলন খুব ভালাে হয়। কুমড়া চাষ।

৪৭।
চাল ভরা কুমড়া পাতা।
লক্ষ্মী বলেন থাকি তথা।

যার গৃহে ভরা কুমড়া থাকে তার কোনই অভাব থাকে না।

[লাউ ও শশা চাষ]

৪৮।
উঠান ভরা লাউ শশা।
ঘরে তার লক্ষ্মীর দশা।

লাউ শশা যে চাষীর উঠান ভরে থাকে, তার কোন অভাব থাকে না। পটোল চাষ।

৪৯।
বুনলে পটোল ফাগুনে।
ফল বাড়ে দ্বিগুণে।

ফাল্গুন মাসে পটোল লাগালে, দ্বিগুণ পটোল ফলে।

৫০।
শােন ওরে চাষার বেটা।
মাটির মধ্যে বেলে যেটা।
তাতেই যদি বুনিস পটোল।
তাতে আশা হবে সফল।

বেলে মাটিতে পটোল লাগালে মনের আশা সফল করবার মত প্রচুর পটোল ফলে থাকে।

[ওল চাষ]

৫১।
ফাগুনে না রুইলে ওল।
হয় শেষে গণ্ডগােল।।

ফাগুন মাসে ওল বসাতে হয়। তাতেই ভালাে ফল নইলে নয়।

৫২।
ছায়ার ওলে চুলকায় মুখ।
কিন্তু তাহে নাহিক দুখ।

ছায়ায় ওল লাগালে সেই ওল খাবার সময় মুখ চুলকায়, কিন্তু ফলন বেশী হয়। |

৫৩।
বলে গেলে বরহের পাে।
দশটি মাসই বেগুন রাে।
চৈত্র বৈশাখ দিয়ে বাদ—
নইলে হবে বরবাদ।

চৈত্র-বৈশাখ বাদ দিয়ে বছরের বাকী দশ মাসই বেগুনের | চাষ করা চলে। ওই দু'মাস যদি বাদ না দেওয়া হয়, তাহলে বেগুন গাছ নষ্ট হয়।

৫৪।
ধরলে পােকা দিবি ছাই।
আর যে ভালাে উপায় নাই।

বেগুন গাছে পোকা লাগলে, ছাই ছড়িয়ে দিয়ে দিলেই পােকা দূর হয়। আলুর চাষ।

৫৫।
বাঁশবনে বুনলে আলু।
আলু হয় বেড়ালু।।

বাঁশবনের ধারে আলু চাষ করলে গাছ খুব তেজী হয় এবং আলুও খুব হয়। তবে গাছকে বেড়া দিয়ে রাখতে হয়।

[ভুট্টা চাষ]

৫৬।
থাকে যদি টাকার গো।
চৈত্র মাসে ভুট্টা রাে।

টাকা উপার্জনের ইচ্ছে থাকলে চৈত্র মাসে ভুট্টা রােপন করা উচিত। কারণ তাতে প্রচুর ফলন হয়। অর্থাগমও নিশ্চিত।

[কচু চাষ]

৫৭।
নদীর ধারে পুঁতলে কচু।
কচু হয় তিন হাত উঁচু।

নদীর ধারে কচু পুঁতলে কচু বড় হয়ে থাকে।

৫৮।
কচু বনে ছড়ালে ছাই।
কচুর ফলন অধিক পাই।

কচু গাছের গোড়ায় ছাই ছড়ালে কচুর ফলন বেশী হয়।

[হলুদ চাষ]

৫৯।
তাস-পাশা দূরে থােও।
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে হলুদ রােও।

খেলায় সময় নষ্ট না করে বরং বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে হলুদ পূতিলে ফলন ভালাে হয়।

৬০।
আষাঢ় শ্রাবণে নিড়াবে মাটি।
ভাদ্রে নিড়ায়ে করবে খাটি।

আষাঢ় শ্রাবণ মাসে মাটি নিড়াতে হয় এবং ভাদ্র মাসে আগাছা নিড়িয়ে নির্মূল করতে হয়। তবেই হলুদ ভালো হয়।

৬১।
অন্য নিয়মে পুতলে হলদি।
ধরণী বলেন তাতে কি ফুল দি।

হলুদ পোতার একটাই মাত্র নিয়ম। অন্য নিয়মে পুঁতলে হলুদ পাবার আশা থাকে না।

[তামাক চাষ]

৬২।
তামাক বুন গুড়িয়ে মাটি।
বীজ পােত গুটি গুটি।

তামাক যদি বুনতে হয়, মাটি খুড়িয়ে ধুলাের মত করে নিতে হয়।

৬৩।
ঘন করে পুতনা।
পৌষের অধিক রেখােনা।।

ঘন ঘন কখনাে তামাক বসাবে না। পৌষ মাসের মধ্যেই তামাক কেটে ঘরে তুলতে হবে নইলে নষ্ট হবে।

[নারিকেল চাষ]

৬৪।
নারিকেল গাছে নুনমাটি।
শীঘ্র শীঘ্ৰ বাধে গুটি।

নারিকেল গাছে নুন মাটি দিলে শীঘ্র শীঘ্র গুটি বেঁধে থাকে ও ভাল ফল দেয়।

৬৫।
দাতার নারিকেল, কৃপণের বাঁশ।
কমে না কখনো, বাড়ে বারাে মাস।।

মাঝে মাঝে নারিকেল পেড়ে খেলে ফল ভাল হয়। বাঁশ না কাটলে, রেখে দিলে বাঁশ ভাল হয়।

৬৬।
খনা বলে শুনে যাও।
নারিকেল মূলে চিটা দাও।
গাছ হয় তাজা মােটা।
শীঘ্র শীঘ্র ধরে গােটা।।

নারিকেলের মূলে ধানের আগড়া (চিটা) দিলে ফল ভাল হয়। গাছ হয় তাজা ও মােটা এবং শীঘ্রই ফলবতী হয়।

[নারিকেল, বাঁশ ও সুপারী রােপণ]

৬৭।
শােনরে বলি চাষার পাে।
সুপারী বাগে মান্দার রো!

মান্দার পাতা পড়লে গােড়ে ফল বাড়ে চটপট করে। সুপারী বাগানে মান্দার রােপণ করলে মান্দার পাতার সারে সুপারী ফলন ভাল হয়। শীঘ্র সতেজ হয়।

৬৮।
নারিকেল বারাে সুপারী আট,
এর ঘন তখনি কাট।

নারিকেল বারাে হাত অন্তর লাগাতে হয়। সুপারী গাছ আট হাত অন্তর। নিয়ম ছাড়া ঘন করে গাছ পুঁতলে গাছে তেমন ফল ধরবে না।

৬৯।
গুয়াতে গােবর, বাঁশেতে মাটি,
অফলা নারিকেলের শিকড় কাটি।
ওলেতে কুটি, মানেতে ছাই !
এইভাবে চাষ করবে ভাই।

গুয়া অর্থাৎ সুপারীতে গােবর সার আর বাঁশে মাটি দিলে ভাল হয়। অফলা নারিকেল গাছের শিকড় কেটে দিলেই ফল ধরে। ওলকচুর গােড়ায় খড়কুটি ও মানের গােড়ায় ছাই দিলে, ওল ও মানকচু ভাল হয়।

৭০।
ফাগুনে আগুন চৈতে মাটি।
তবেই বাঁশের পরিপাটি।।

ফাল্গুনে যদি বাঁশ ঝাড়ে আগুন দেওয়া হয় এবং চৈত্র মাসে যদি তপ্ত মাটি গােড়ায় পড়ে, তাতে বাঁশ ঝাড় খুব বাড়ে।

৭১।
শুন ওরে চাষার বেটা।
বাঁশ ঝাড়ে দাও ধানের চিটা।
দিলে চিটা বাঁশের গােড়ে।
দুই কুমড়া ভূই বেড়বে ঝাড়ে।

বাঁশেতে ধানের আগড়া বা চিটা দিলে বাঁশ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। কারণ তা বাঁশের খুব ভাল সার হয়ে থাকে।

[তাল চাষ]

৭২।
এক পুরুষ রোয় তাল।
পর পুরুষে করে পাল।
তারপরে যে সে খায়।
তিন পুরুষে ফল পায়।।

বাপ যদি তাল লাগায়, পুত্রকে সেই তালগাছ পালতে হয়। তবেই তাতে তাল ধরে। সেই তাল সে ও তার পুত্রের ভােগে লাগে।

৭৩।
বারো বছরে ফলে তাল।
যদি না লাগে গরুর লাল।।

গরুর হাল লাগলে তালগাছ বিনষ্ট হয় অর্থাৎ গরুতে যদি তাল পাতা না খায় তাহলে বারাে বছর পরে সে তাল গাছে তাল ধরে।

[আম ও কাঁঠাল চাষ]

৭৪।
হাত বিশেক করি ফাঁক,
আম-কাঁঠাল পুঁতে রাখ।
ঘন ঘন সবে না,
ফল তাতে হবে না।

বিশ হাত অন্তর অন্তর আম-কাঁঠাল লাগাতে হয়। ঘন ঘন পুঁতলে গাছে ফল হবে না।

৭৫।
অগ্ৰাণে যদি বৃষ্টি না পড়ে।
গাছে কাঁঠাল নাহি ধরে।।

অগ্রহায়ণ মাসে যদি বৃষ্টি না হয়। গাছে সে বছর কাঁঠালই ধরবে না।

[মূলা ও ইক্ষু চাষ]

৭৬।
খনা বলে শুন শুন।
শরতের শেষে মূলা বুন।।
মূলার ভূই তুলা। কুশরের ভূই ধূলা।।

শরতের শেষে মূলা বােনার নিয়ম। মূলার জমি তুলার ন্যায় নরম হওয়া উচিত। আখ চাষের মাটি ধূলার ন্যায় হওয়া উচিত।

[আউস ও পাটের জমি ও সার]

৭৭।
বেলে জমিতে আউশ ফলে।
পাটের ভূই আটালে।

বেলে জমিতে আউশ ধান ভাল হয়। আঁটালে জমি পাটের পক্ষে ভাল।

৭৮।
পঁচা সরায় গাছলা বাড়ে।
গোঁধলা দিয়ে মানুষ মরে।

পঁচা গোবরের গন্ধে গাছের তেজ বাড়ে। যা মানুষের পক্ষে ক্ষতিকারক, তাহাই গাছের পক্ষে উপকারী।

৭৯।
শােনরে মালি বলি তােরে।
কলম রাে শ্রাবণের ধারে।।

কলমের চারা শ্রাবণ মাসে পুঁতলে চারা খুব সতেজ ও ভাল হয়।

৮০।
গো নারিকেল নেড়ে রাে।
আমটুচুরে কাঁঠাল ভাে।

নারিকেল ও সুপারী চারা নেড়ে রােপণ করলে ফল খুব ছােট হয়, আর কাঠাল একেবারে ভুয়া অর্থাৎ কোয়াহীন হয়।

[ধানের পক্ষে অশুভ বৎসর]

৮১।
শনি রাজা মঙ্গল পাত্র।
চাষা খােড়া সার মাত্র।।

যে বছর শনি রাজা আর মঙ্গল মন্ত্রী হয়, সে বৎসর ধান ফলার কোন আশাই থাকে না।

[শস্যাদি শুভ বৎসর]

৮২।
বুধ রাজা, শুক্র তার মন্ত্রী যদি হয়।
শস্য হবে খেতে পুরা নাহিক সংশয়।

যে বছর বুধ রাজা এবং শুক্র মন্ত্রী হয়, সে বৎসর শস্যাদি খুব ভালাে হয়।

[সাগরের তীরে গুটিকাপাত]

৮৩।
যদি সাগর তীরে গুটিকাপাত।
সে বৎসর ফসলের জানি কুশলবাত।।
শস্যপূর্ণ বসুন্ধরা নাহিক সংশয়।
খনার বচন কভু মিথ্যা নাহি হয়।

সাগর তীরে গুটিকাপাত হলে বসুন্ধরা শস্যপূর্ণ হইয়া থাকে খনার এ বচন কভু মিথ্যা হবার নয়।

[সরিষা, রাই কার্পাস, কোষ্টা রােপণ]

৮৪।
সরষে ঘন পাতলা রাই
নেঙ্গে নেঙ্গে কার্পাস যাই।
কার্পাস বলে কোষ্টা ভাই
জ্ঞাতি পানি না যেন পাই।

সরষে খুব ঘন করে বুনতে হয়। রাই কিছু ফাঁক ফাঁক করে বুনলে ভালাে হয়। কার্পাস এমন ভাবে বুনতে হবে যেন দাঁড়িয়ে তুলতে পারা যায়। কার্পাস ও পাট একই জমিতে বােনা উচিত নয়। কারণ পাটের জল কার্পাসে লাগিলে গাছের ক্ষতি হয়, ফলের আশা থাকে না।

[তুলার চাষ]

৮৫।
খনা বলে শুন ভাই।
তুলায় তুলা অধিক পাই।

কার্তিক মাসে বৃষ্টি হলে তুলার চাষ ভাল হয়।

[ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, কুয়াশা, অনাবৃষ্টি, বর্ষগণনা, অতিবৃষ্টি, ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ, মড়ক, ধর্মার্থে উপবাসের দিন ইত্যাদি]

৮৬।
বাদ দিয়ে বর্ষা।
খনার বচন ফরসা।
শনি সাত মঙ্গল তিন।
আর সব দিন দিন।

বর্ষাকাল বাদ দিয়ে অন্য সময় বৃষ্টি হলে শনিবার শুরু হলে সাতদিন, মঙ্গলবার শুরু হলে তিন দিন চলে বাকী সব একদিন মাত্র স্থায়ী হয়।

৮৭।
পূর্ণ আষাঢ়ে দক্ষিণা বয়।
সেই বৎসর বন্যা হয়।।

সারা আষাঢ় মাস ধরে দক্ষিণা বাতাস বইলে, সে বৎসর বন্যা হবেই হবে।

৮৮।
বামুন বাদল বান।
দক্ষিণা পেলেই যান।

ব্রাহ্মণ যেমন দক্ষিণা পেলেই বিদায় হন তেমনি বাদল ও বান দক্ষিণা বাতাস পেলেই চলে যায়।

৮৯।
আমে ধান। তেঁতুলে বান।

যে বছর আমের ফলন বেশী হয়, সে বৎসর ধান ভাল হয়। তেঁতুলের ফলন বেশী হলে বন্যা হয়।

৯০।
চৈত্রে কুয়া ভাদ্রে বান।
নরের মুগু গড়াগড়ি যান।

যে বছর চৈত্র মাসে কুয়াশা আর ভাদ্র মাসে বন্যা হয়, সে বছর প্রচুর লােক ক্ষয় হয়ে থাকে।

৯১।
পৌষে গরমী বৈশাখে জাড়া
প্রথম আষাঢ়ে ভরবে গাড়া।

যে বছর পৌষ মাসে গরম ও বৈশাখে ঠাণ্ডা পড়ে, সে বছর প্রথমে আষাঢ়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং শ্রাবণে অনাবৃষ্টি হয়ে।

৯২।
পূর্বেতে উঠিলে কাড়।
ডাঙ্গ ডোবা একাকার।।

বর্ষাকালে পূর্ব আকাশে যদি রামধনু দেখা যায়। তাহলে প্রবল বৃষ্টিপাতে ডাঙ্গা ডােবা সব জলে ভরে যায়।

৯৩।
চাঁদের সভার মধ্যে তারা।
বর্ষে পানি মূষল ধারা।

চন্দ্রমণ্ডলের মধ্যে যদি তারা দেখা যায়। তাহলে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।

৯৪।
খনা বলে শুনহ বাণী
শ্রাবণ ভাদ্রে নাইকো পানি।
দিনে জল রাতে তারা 
এই দেখবে দুঃখের ধারা।।

শ্রাবণ ভাদ্র মাসে যদি বৃষ্টি না হয়। বর্ষার শুরুতে যদি দিনে জল আর রাত্রে পরিষ্কার থাকে, তবে মানুষের দুঃখ দুর্দশার সীমা থাকে না।

৯৫।
পশ্চিমে ধনু নিত্য খরা।
পূর্বে ধনু বর্ষে ধারা।।

পশ্চিম আকাশে রামধনু উঠলে খরা হয়ে থাকে- কিন্তু আকাশে রামধনু উঠলে অতি বৃষ্টি হয়ে থাকে।

৯৬।
ব্যাঙ ডাকে ঘন ঘন।
শীঘ্র বর্ষা হবে জেনাে।।

ঘন ঘন ব্যাঙ ডাকলে বুঝতে হবে খুব শীঘ্রই বৃষ্টি হবে।

৯৭।
পৌষে কুয়া বৈশাখে ফল।
য’দিন কুয়া ত’দিন জল।

পৌষ মাসে যতদিন কুয়াশা হয়, বৈশাখ মাসে প্রায় ঠিক তত দিনই বৃষ্টি হয়।

৯৮।
ভাদুরে মেঘ বিপরীত হয়।
সেদিনই বৃষ্টি হয়।

ভাদ্র মাসের আকাশে যদি মেঘ থাকে এবং বায়ু যদি বিপরীত প্রবাহিত হয়, সেদিন বৃষ্টি অবধারিত।

৯৯।
চৈত্রে কাঁপে থর থর।
বৈশাখে ঝড় পাথর।
জ্যৈষ্ঠতে তারা ফুটে।
তবেই জানবে বর্ষা বটে।

যে বছর চৈত্র মাসে শীত থাকে, বৈশাখে শীলাবৃষ্টি হয়, জ্যৈষ্ঠ মাসে আকাশ পরিষ্কার থাকে, সে বছর প্রবল বর্ষণ হয়।

১০০।
বৎসরের প্রথম ঈশান হয়।
হবেই বর্ষা খনা কয়।

বৎসরের শুরুতেই যদি ঈশান কোণ থেকে বাতাস বইতে আরম্ভ করে তাহলে প্রবল বর্ষণের আশঙ্কা থাকে।

১০১।
দূরে সভা নিকটে জল।
নিকট সভা রসাতল।

দূরে চাঁদের সভা বসলে খুব শীঘ্র বৃষ্টি হবে জানবে। নিকট চাঁদের সভা বসলে বৃষ্টি হবে না।

১০২।
খনা বলে শোন চাষা।
কার্তিক পূর্ণিমা কর আশা।
নির্মল মেঘ যদি রাত রবে।
রবিশস্য ভার ধরণী না সবে।

কার্তিক মাসে পূর্ণমাসী রজনীর সময়, আকাশ যদি পরিষ্কার থাকে অর্থাৎ মেঘশূন্য নির্মল থাকে তাহলে রবিশস্য প্রচুর পরিমাণে জন্মায়।

১০৩।
যদি বর্ষে অগ্ৰাণে।
রাজা যান মাগনে।

অগ্রহায়ণ মাসে বৃষ্টি হলে, কীট শস্য নষ্ট করে। রাজস্ব আদায় হয় না। রাজ্যের চতুর্দিকে অভাব পরিলক্ষিত হয়।

১০৪।
যদি বর্ষে পৌষে।
কড়ি হবে তুষে।

পৌষ মাসে বৃষ্টি হলে তুষ বিক্রি করেই প্রচুর টাকা পাওয়া যায়।

১০৫।
যদি বর্ষে মাঘের শেষ।
ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।।

যদি মাঘ মাসের শেষে বৃষ্টি হয়, তাহলে প্রচুর রবিশস্য উৎপন্ন হয়। চাষীর হাতে পয়সা আসে, মানুষের অভাব অনটন থাকে না।

১০৬।
মাঘ মাসে বর্য্যে দেবা।
রাজ্য ছাড়ে প্রজার সেবা।।

মাঘ মাসে বৃষ্টি হলে, প্রচুর ফসল উৎপন্ন হয়। প্রজারা সুখী হয়। তাদের জন্য রাজার কোন চিন্তাই থাকে না।

১০৭।
যদি বর্ষে মকরে,
ধান্য হবে টেকরে।।

মাঘ মাসে বৃষ্টি হলে, উচ্চ জমিতেও প্রচুর ধান উৎপন্ন হয়।

১০৮।
যদি বর্ষে ফল্গুনে।
চিনা কাউন দ্বিগুণে।।

ফাল্গুন মাসে বৃষ্টি হলে, চীনা বীজের ধান প্রচুর উৎপন্ন হয়।

১০৯।
যদি বর্ষে চৈত্রে বৃষ্টি।
তবে হবে ধানের সৃষ্টি।

চৈত্র মাসে বৃষ্টি হলে, ধানের ফসল ভাল হয়।

১১০।
জ্যৈষ্ঠে শুকনা, আষাঢ়ে ধারা।
শস্যের ভার না সহে ধরা।

জ্যৈষ্ঠ মাস যদি শুকনা যায় এবং আষাঢ় মাসে যদি বর্ষা হয়। শস্যের ফলন খুব ভাল হয়।

১১১।
জ্যৈষ্ঠে মারে আষাঢ়ে ভরে।
কাটিয়া মাড়িয়া ঘর করে।

জ্যেষ্ঠ মাসে বৃষ্টি না হলে, আষাঢ় মাসে বৃষ্টি হলে ধানের ফলন অধিক হয়।

১১২।
কি কর শ্বশুর লেখা জোখা।
আষাঢ়ী নবমী শুক্লা পখা।
যদি বর্ষে মূষলধারে।
মাঝ সমুদ্রে বগা চরে।
যদি বর্ষে ছিটে ফোটা।
পর্বতে হয় মীনের ঘটা।
বর্ষে যদি ঝিম ঝিমানি।
শস্যের ভার না সয় মেদিনী।।

যে বছর আষাঢ় মাসে শুক্লা নবমীতে মুষলধারে বৃষ্টি হবে সে বছর অনাবৃষ্টি হবে। ছিটে ফোটা বৃষ্টি হলে খাল বিল, নদ-নদীতে প্রচুর মাছ হবে। অল্প অল্প বৃষ্টি হলে শস্যের উৎপাদন ভাল হবে।

১১৩।
হেসে চাকি বসে পাটে,
সে বছর শস্য না মােটে।

যে বছর আষাঢ় মাসে অস্তগামী সূর্য হেসে পাটে বসে, সে বছর শস্য জন্মায় না।

১১৪।
কি কর শ্বশুর লেখাজোখা।
মেঘেই থাকে জলের রেখা।
কোদালে কুড়ুলে মেঘের ঢাকা।
মধ্যে মধ্যে দিচ্ছে ঘা।
বলাে চাষায় বাধতে আল।
আজ না হয় হবে কাল।।

লেখাজোখার দরকার নেই। মেঘেই প্রমাণ হয় বর্ষা কেমন হবে। কোদালে কুড়ালে মেঘ দেখলেই মাঝে মাঝে বাজের আওয়াজ শুনলেই ধরে নিতে হবে, তুমুল বর্ষণ আসন্ন। তখন চাষীদের আল বেঁধে রাখা উচিত। কারণ সেদিন না হলেও দুএক দিনের মধ্যে বর্ষণ হবেই ধরে নিতে হবে।

[রবিবার দোষে অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি]

১১৫।
পাঁচ রবি যে মাসে পায়।
ঝরা কিংবা খরায় যায়।

যে বৎসর একটি মাসে পাঁচটি রবিবার পড়ে, সে মাসে হয়। বৃষ্টি, নয় খরা হবে। ভূমিকম্প ও অতিবন্যা।

১১৬।
খনা বলে শুন শুন ওগাে পতির পিতা।
ভাদ্র মাসে জলের মধ্যে নড়েন বসুমাতা।।
রাজ্যনাশ গো-নাশ হয় অগাধ বান।
হাতে কাঠা গৃহী ফেরে কিনতে না পায় ধান।।

যদি ভাদ্র মাসে জল হয় এবং তার সাথে সাথে ভূমিকম্প হয় তাহা হইলে সে বৎসর মহা অমঙ্গল হয়ে থাকে। মড়ক, দুর্ভিক্ষ, গাে-নাশ এতই অধিক হয় যে, দ্বারে দ্বারে মানুষ ঘুরিয়াও এক মুঠা ভিক্ষা পায় না।

[তিথি অনুযায়ী বর্ষ গণনা]

১১৭।
ফাগুনে রােহিনী নক্ষত্র যদি থাকে ভাই।
আগামী বৎসর গণে গণে পাই।।
সপ্তমী অষ্টমীতে হয় ধান।
নবমীতে বন্যা, দশমীতে নির্মূল পাতান।।

ফাল্গুন মাসে রােহিনী নক্ষত্রে যদি সপ্তমী অষ্টমী তিথি হয়। তাহা হইলে শস্য ভাল হয়। নবমী পড়িলে বন্যা হয় দশমী হইলে মহা সর্বনাশ হইয়া থাকে।

[শনির অবস্থান ভেদে চৈত্রমাসের ফল]

১১৮।
মধুমাসে ত্রয়ােদশ দিনে যদি থাকে শনি।
খনা বলে সে বৎসর হবে শস্যহানি।।

যে বৎসর চৈত্র মাসের ত্রয়ােদশ দিনে শনি অবস্থান করে সে বৎসর শস্যহানি হয়।

[চৈত্র মাসের বার দোষে দুর্ভিক্ষ ও মড়ক]

১১৯।
মধুমাসে প্রথম দিবসে হয় যেই বার।
রবি শেষে মঙ্গল বর্ষে দুর্ভিক্ষ বুধবার।
সােম শুক্র আর গুরুবার।
পৃথিবী না সয় শস্য ভর।
পাঁচ শনি পায় মীনে।
শকুনি মাংস না খায় ঘূণে ৷

চৈত্র মাসের প্রথম দিন রবিবার হলে অনাবৃষ্টি হয়। প্রথম দিন মঙ্গলবার হলে ভালাে বর্ষণ হয়। প্রথম দিন বুধবার হলে, দুর্ভিক্ষ হয়। প্রথম দিন সােম, শুক্রবার কিংবা বৃহস্পতিবার হলে, প্রচুর। শস্য উৎপন্ন হয়। চৈত্র মাসে যদি পাঁচটি শনিবার থাকে, সে বৎসর মড়কে মানুষ ও পশু মারা যায়।

[ধর্মার্থে উপবাসের দিন]

১২০।
শয়ন উত্থান পাশ মােড়া।
তার মধ্যে ভীম ছােড়া।
দুই ছেলের জন্মতিথি।
অষ্টমী নবমী তিথি।
পাগলার চৌদ্দ পাগলীর আট।
এই নিয়ে কাল কাটা।

শয়নে, উত্থানে, পার্শ্ব একাদশী, ভৈমী একাদশী, জন্মাষ্টমী, রাম নবমী, শিব চতুর্দশী ও মহাষ্টমীতে উপবাস করা উচিত। ইহাতে পুণ্য সঞ্চয় হয় ও মৃত্যুর পর দেবলােকে বাস হয়।

খনার জ্যোতিষ গণনা গুলো পড়তে নিচের “জ্যোতিষ গণনা” বিষয়ক বাকি পোস্ট  গুলো  পড়ুন।

প্রিয় পাঠক, খনার এই বচন সমূহ “খনার বচন” নামক গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত করা হয়েছে।

Previous Next
No Comments
Add Comment
comment url