কিডনিতে পাথর হওয়ার কারণ ও ডাক্তারি চিকিৎসা পরামর্শ

পাথর হওয়ার প্রবণতা বলতে কি বুঝায়? পাথর কেন হয় তা আমরা এখনও পুরােপুরি জানি না। তবে পরিসংখ্যান নিয়ে দেখা গেছে নীচের কারণগুলির এক বা একের বেশী যদি কারাের মধ্যে থাকে তার ক্ষেত্রে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
(১) বংশগত। নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কারোর যদি পাথর থাকে
(২) ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস
(৩) জল কম খাওয়া
(৪) ওষুধ। নির্বিচারে মাথাব্যথার ওষুধ খেয়ে যাওয়া—যাকে বলে অ্যানালজেসিক অ্যাবিউজ। এ বিষয়ে আরো জানাচ্ছেন ডাঃ শিবাজী বসু

❍ প্রশ্ন:  পালংশাক খেলে কিডনিতে পাথর হয়?

☛ উত্তর:  ঠিক তা নয়। আপনার মধ্যে যদি পাথর হওয়ার প্রবণতা থাকে অথবা একবার পাথর হয়ে গিয়ে থাকে সেক্ষেত্রে পালংশাক খেতে নিষেধ করা হয়।

❍ প্রশ্ন:  কী রকম খাওয়া দাওয়া করলে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে?

☛ উত্তর:  চিজ, পাঁঠা-খাসির মাংস খাবার তালিকায় কম থাকা ভাল। দুধের বদলে ছানা বা দই খাওয়া। আর প্রচুর পরিমাণে জল। দিনে ২-৩ লিটার। স্বাভাবিক ধারায় প্রচুর প্রস্রাব হলে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

❍ প্রশ্ন:  কিডনিতে পাথর হয়েছে কীভাবে বােঝা যাবে?

☛ উত্তর:  এর কোনও নির্দিষ্ট হিসেব নেই। একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম উপসর্গ দেখা দেয়। কারাে কারাে পিঠের কাছে কোমরের ওপর দিকটায় খুব যন্ত্রণা হয়। ব্যথা সেখান থেকে সামনের দিকে আসে এবং ওঠানামা করে। কখনও আবার প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত পড়ে। শুধু পিঠে ব্যথা হলে অনেকে আর্থাইটিস ভেবে ব্যথা কমার ওষুধ খেয়ে যান। ফলে বিপদ বাড়ে। অনেকের বারবার জ্বর আর প্রস্রাবে সংক্রমণ হতে থাকে। সব থেকে বিপদ হয় তাঁদের নিয়ে, যাঁদের কোনও রকম কষ্টই থাকে না।

❍ প্রশ্ন:  কোনও কষ্টই থাকে না?

☛ উত্তর:  হয়ত কিছু থাকে, অম্বল, হজমের গণ্ডগােল, কোষ্ঠকাঠিন্য, অর্থাৎ এমন কিছু যা থেকে সহজে বােঝবার উপায় নেই কি পাথর আছে।

❍ প্রশ্ন:  তবে তাে খুব বিপদ !

☛ উত্তর:  হ্যাঁ, হতে পারে। আবার হয়ও না। লাগাতার অম্বল, হজমের গণ্ডগােল দেখে ডাক্তার হয়তাে ভাবলেন গলব্লাডারে কোনও সমস্যা হয়েছে কিনা। সেইমতাে আলট্রা সনােগ্রাফি করানাে হল। দেখা গেল গলব্লাডার ঠিকই আছে। পাথর রয়েছে কিডনিতে।

❍ প্রশ্ন:  তাহলে রােগ যথাসময়ে ধরা নাও পড়তে পারে?

☛ উত্তর:  সেটাই তাে সমস্যা। যাঁদের রােগের সূত্রপাতেই প্রস্রাবে দিয়ে রক্ত আসতে শুরু করে তাঁরা সেই অর্থে ভাগ্যবান। ভয় পেয়ে দৌড়ে আসেন ডাক্তারের কাছে। ফলে চটপট চিকিৎসা হয়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে যান। যাদের উপসর্গ কেবল পিঠ ব্যথা তাঁরা হয় মুঠো মুঠো ব্যথা কমানাের ওষুধ খান। নয়তাে হােমিওপ্যাথি করান। ফলে শেষমেশ যখন আসেন, কিডনিও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। অল্প জ্বর, প্রস্রাবে সংক্রমণের সঙ্গে যদি ব্যথা না থাকে অ্যান্টিবায়ােটিক খেতে থাকা খুব চাল অভ্যেস। ফলে রােগ বেশ জাঁকিয়ে বসে। অথচ একটু সচেতন হলে রােগ নির্ণয় কঠিন কিছু নয়।

❍ প্রশ্ন:  কীভাবে হবে রােগ নির্ণয়?

☛ উত্তর:  প্রথমে সাধারণ প্রস্রাব পরীক্ষা করে দেখে নিতে হবে রক্ত আছে কিনা। পেটের একটা এরে। এবং সম্ভব হলে ওপর পেটের আলট্রাসনােগ্রাফি। পাথর থাকলে এতেই সব কিছু জানা যাবে। এরপর চিকিৎসা শুরু করার আগে পেটের একটি বিশেষ ধরনের এক্সবে, ইন্ট্রাভেনাস ইউরােগ্রাম বা আই ভি ইউ করে দেখে নিতে হবে কিডনির কার্যক্ষমতা ঠিক আছে কিনা।

❍ প্রশ্ন:  পাথর হলে কি অপারেশন করাতেই হবে?

☛ উত্তর:  সব সময় নয়। ছােট পাথবের ক্ষেত্রে অনেক সময় অপারেশন দরকার হয় না। কিছু ওষুধপত্র আর দিনে ৪ লিটার জল। এছাড়া ৪ চামচ কুলখ কলাই এক গ্লাস জলে সারারাত ভিজিয়ে রেখে রােজ সকালে সেই জল খেতে হবে। ছােট পাথর এতেই অনেক সময় প্রস্রাবে মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে যায়। এর সঙ্গে অবশ্য নিয়ম করে ৬ মাস বাদে বাদে আলট্রাসনোেগ্রাফি করে দেখে নিতে হবে কিডনি ঠিক আছে কিনা।

❍ প্রশ্ন:  হােমিওপ্যাথিতে শুনেছি পাথর গলিয়ে দেয়?

☛ উত্তর:  আমি ঠিক জানি না। তবে শুনেছি ছােট পাথর অনেক সময় প্রস্রাবের মধ্যে দিয়ে বার করে দিয়েছেন ওঁরা। তবে আমি বলব হােমিওপ্যাথি ওষুধ খান আর যাই করুন ৬ মাস অন্তর অন্তর আলট্রাসনােগ্রাফি করিয়ে দেখবেন পাথর সত্যিই বেরিয়ে গেছে কিনা। বা কিডনির অবস্থা কী।

❍ প্রশ্ন:  পাথর বড় হলে অপারেশন করতে হবে?

☛ উত্তর:  পাথর বার করার আপাতত তিনটি পদ্ধতি আছে।
(১) পেট কেটে অপারেশন করে।
(২) আলট্রাসাউন্ডের সাহায্যে পাথর গুড়িয়ে প্রস্রাবের মধ্যে দিয়ে বার করে আনা। যার নাম লিথােট্রিপসি।
(৩) এন্ডােস্কোপিক পদ্ধতির সাহায্যে পিঠে ছােট একটি ফুটো করে সেখান দিয়ে যন্ত্রপাতি ঢুকিয়ে তার মাধ্যমে। এর নাম পি সি এন এল বা পারকিউটেনিয়াস নেফ্রোলিথােটমি। পেট কাটার কয়েকটি অসুবিধেজনক দিক থাকায়, খরচ সাপেক্ষ হলেও দ্বিতীয় আর তৃতীয় পদ্ধতি দুটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে বেশি।

❍ প্রশ্ন:  অসুবিধেজনক দিক বলতে? ঘরে বেশিদিন আটকে থাকা?

☛ উত্তর:  তা তাে আছেই। এছাড়া পাথর একবার হলে সাবধানতা যথাযথ পালন করলেও আবার হওয়ার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। কিডনির ওপর বারবার কাটাছেড়া বাঞ্ছনীয় নয়। তবে আমার ব্যক্তিগত মত, পাথরের ধরন যদি খুব জটিল না হয় আর রােগীর আর্থিক সঙ্গতিও যদি সে রকম না থাকে, প্রথমবার অপারেশন করানাে যেতে পারে।

❍ প্রশ্ন:  তবে কি, কী পদ্ধতিতে পাথর বার করবেন তা পাথরের ধরনের ওপর নির্ভর করে?

☛ উত্তর:  কিছুটা তাই। তবে রােগীর মর্জির ওপরও ব্যাপারটা নির্ভর করে। পাথরেব আকার খুব বড় হলে পি সি এন এল করা উচিত। ইউরিন পাইপে পাথর থাকলে লিথােক্লাস্ট অর্থাৎ ইউরিনের রাস্তা দিয়ে সরু নল ঢুকিয়ে আলট্রাসাউন্ডের সাহায্যে পাথর গুঁড়িয়ে বার করে আনা যায়। কেউ যদি মনে করেন পুরােপুরি যন্ত্রণা বিহীন অপাবেশন লিথােটিপসি করাবেন, তাও করা যেতে পারে। আর সাজারি তাে আছেই।

❍ প্রশ্ন:  লিথােট্রিপসিতে পাথর পুরােপুরি বেরােয়?

☛ উত্তর:  একবারে না বেরােতেও পারে। বড় পাথর হলে বেশ কয়েকটা সিটিং দরকার হয়। এবং পাথর পুরােপুরি বেরােলাে কিনা তা এরে করে দেখে নেওয়া হয়।

❍ প্রশ্ন:  লিবােট্রিপসিব খরচ কী রকম?

☛ উত্তর:  কটা সিটিং দরকার তার ওপর নির্ভর করে। মােটামুটি ১৫-২৫ হাজার টাকার মতাে।

❍ প্রশ্ন:  লিথােটিপসি করার ৬ মাস পরে দেখা গেছে পাথর রয়ে গেছে। এরকম কেন হয়?

☛ উত্তর:  পাথর রয়ে গেছে এই ধারণাটা ঠিক নয়। প্রতি ৪ কিডনি স্টোন রােগীর মধ্যে একজনের বারবার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এবং পাথর মুক্ত হওয়ার ৬ মাসের পর থেকে যে কোনও সময় আবার পাথর হতে পারে।

❍ প্রশ্ন:  তাহলে কি বারবারই এসব পদ্ধতি চালিয়ে যেতে হবে?

☛ উত্তর:  না। ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। যাঁদের দু'টো কিডনিতেই পাথর হয় বা বারবার হওয়ার প্রবণতা থাকে তাঁদের কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে বলি আমরা। সাধারণত যদি কারাের গাউট থাকে, রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে বা প্যারাথাইরয়েড টিউমার থাকলে এরকম হতে পারে। সেক্ষেত্রে রােগের চিকিৎসা করলে পাথরের সমস্যাও কমে আসে।

❍ প্রশ্ন:  অপারেশনের পর কী কী নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয়?

☛ উত্তর: পেট কেটে অপারেশন হলে হাসপাতালে থাকতে হবে ৭-১০ দিন। তারপর একস বিশ্রাম। পি সি এন এল করলে হাসপাতালে ৩ দিন আর বাড়িতে দিন ৪-৫। লিথােট্রিপসির ক্ষেত্রে সে দিনই রােগী বাড়ি চলে যেতে পারেন। তবে পাথরের আকার এবং কাঠিন্যের ওপর নির্ভর করে ২-৩ বার এমনকি কখনও ৫-৬টা সিটিংয়েরও দরকার হয়। প্রতিটি সিটিংয়ের মধ্যে ১০-১২ দিনের পার্থক্য থাকে। এবার খাবার দাবার। প্রথমেই পাথরের চরিত্র নির্ধারণ করে জেনে নেওয়া হয় কী কারণে পাথর হয়েছিল। তারপর সেই অনুযায়ী খাওয়া দাওয়ার নিয়ম কানুন বেঁধে দেওয়া হয়। সাধারণত দুধ, চিজ, পাঁঠা-খাসির মাংস, কচু, পালংশাক, স্যালাড ইত্যাদি না খাওয়া উচিত। আর জল খাওয়া উচিত দিনে কম করে ৪ লিটার। এছাড়া, প্রতি বছর নিয়ম করে এক্সরে এবং প্রস্রাব পরীক্ষা অবশ্যই করতে হবে। যদি মনে হয় ভুলে যাবেন তাহলে আপনার জন্মদিনের দিনটি এ বাবদ ধার্য করুন। তাহলে আর ভােলার সম্ভাবনা থাকবে না।

❍ প্রশ্ন:  লিথােট্রিপসি করালে নাকি কিডনির কার্যক্ষমতা কিছুটা কমে যায়? এবং পরবর্তী কালে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেবার প্রবণতা থাকে?

☛ উত্তর:  লিথােট্রিপসি করার পর ২-৩ সপ্তাহ কিডনি একটু কম কাজ করে। তবে ধীরে ধীরে সেটা আবার ঠিক হয়ে যায়। আর উচ্চ রক্তচাপের ব্যাপারটা এখনও গবেষণাধীন। তবে সেরকম কিছু নজরে পড়লে ডাক্তারকে জানানাে উচিত। 

Previous Next
No Comments
Add Comment
comment url