ডায়াবেটিস থেকে মুক্তির উপায় এবং রোগীদের জন্য চিকিৎসা পরামর্শ

ডায়াবেটিসে আজকাল সব কিছু খাওয়া যায় কি? না, কিছু বিধি নিষেধ আছে। তবে আগে যে রকম ধারণা ছিল মাটির নীচের সবজি, ভাত, ফল ইত্যাদি খাওয়া যায় না, সে ধারণা এখন বদলেছে। রিফাইনড্ কার্বোহাইড্রেট অর্থাৎ চিনি, গুড়, মিষ্টি মধু, জ্যাম জেলি ইত্যাদি বাদ দিয়ে বাকি সব কিছুই অল্প বিস্তর খাওয়া যেতে পারে। তবে ডায়াবেটিসে ওজন নিয়ন্ত্রণও কিন্তু খুব জরুরি। কাজেই খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকা দরকার। আরো জানাচ্ছেন ডাঃ সুদীপ চ্যাটার্জি এবং অধ্যাপক ডাঃ জয়ন্ত বসু

❍ প্রশ্ন: ডায়াবেটিসে কী ধরনের খাবার খেতে হবে?

☛ উত্তর:  সঠিক ভাবে মেপে খেতে পারলে, এক বেলা ভাত একবেলা রুটি খাওয়া যায়। নয়তাে ভাত কুটি মিশিয়ে। রুটি হবে লাল আটার। কারণ রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে ফাইবার জাতীয় খাবারের ভূমিকা আছে। ময়দা রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেটের পর্যায়ে পড়ে। অতএব খাওয়া চলবে না। সব ধরনের শাকসবজি মিলিয়ে মিশিয়ে খেতে হবে। সম্ভব হলে খোসাসুদ্ধ খেলে বেশি ফাইবার পাওয়া যাবে। ওল, কচু, আলু ইত্যাদি যথাসম্ভব কম খাওয়া দরকার। ডায়াবেটিস রােগীর রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ খুব জরুরি। কাজেই ডিমের কুসুম বা খাসির মাংসের বদলে যে কোনও মাছ, ডিমের সাদা অংশ এবং মুরগির মাংস খাওয়া ভাল। ঘি, মাখন, বনস্পতি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা দরকার। রােজ কিছু না কিছু ফল অল্প পরিমাণে খেতে হবে। পেপে, মুসুম্বি, আম, কলা, পেয়ারা, আপেল, আতা, সবেদা ইত্যাদি খেতে পারেন।

❍ প্রশ্ন:  বেশি মিষ্টি খেলে কি ডায়াবেটিস হয়?

☛ উত্তর:  না, ডায়াবেটিস হয় শরীরে ইনসুলিনের ঘাটতি হলে। নানা কারণে তা হতে পারে। প্যানক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন একেবারে না বেরােলে ইনসুলিন ডিপেনডেন্ট ডায়াবেটিস (IDDM) বা টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস হয়। মােট ডায়াবেটিক রােগীর এরা মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ। ইনসুলিন প্রয়ােজনের তুলনায় কম বেরােলে হয় নন ইনসুলিন ডিপেনডেন্ট ডায়াবেটিস (NIDDM) বা টাইপ টু ডায়াবেটিস। ৯০-৯৫ শতাংশ ডায়াবেটিস রােগীই এতে ভােগেন। সামান্য কিছু ক্ষেত্রে কোনও রােগের কারণেও ডায়াবেটিস হতে পারে। তাকে বলে সেকেন্ডারি ডায়াবেটিস।

❍ প্রশ্ন:  গর্ভাবস্থায়ও তাে ডায়াবেটিস হয়?

☛ উত্তর:  অনেক সময় আগে থেকে থাকে, ধরা পড়ে গর্ভাবস্থায় রক্ত পরীক্ষা করাতে এসে। কিছু ক্ষেত্রে সূত্রপাতই হয় গর্ভাবস্থায়। তাকে বলে জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস। সন্তান জন্মের পর জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস ঠিক হয়ে যায়।

❍ প্রশ্ন:  উচ্ছে, করলা, নিমপাতা, মেথির গুঁড়াে নিয়মিত খেলে ডায়াবেটিস আয়ত্তে থাকে?

☛ উত্তর:  ডায়াবেটিস প্রতিরােধের ক্ষমতা রাখে এমন প্রায় শ-পাঁচেক প্রাকৃতিক উপাদান আছে। মেথি, নয়নতারা পাতা বা তেলকুচা পাতা তার মধ্যে অন্যতম। নয়নতারা পাতার উপর বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। দেখা গেছে এর মধ্যে ক্যান্সার প্রতিরোধী কিছু রাসায়নিকও আছে। তাই ডায়াবেটিস প্রতিরােধের জন্য নয়নতারা পাতা খাওয়ার কথা বলা হয়ত নিরাপদ নয়। মেথিতে ক্ষতি তেমন কিছু নেই। উচ্ছে, করলা বা নিমপাতা ততা খাওয়া যেতেই পারে। তবে এর ফলে ডায়াবেটিস কতটা কমবে বা আদৌ কমবে কিনা সেটা সঠিকভাবে বলা যাবে না।

❍ প্রশ্ন:  স্যাকারিন থেকে নাকি ক্যান্সার হয়?

☛ উত্তর:  না, স্যাকারিন থেকে ক্যান্সার হয় না। ডায়াবেটিস রােগী দিনে বার তিনেক স্যাকারিন দেওয়া চা খেতে পারেন।

❍ প্রশ্ন:  ভােরবেলা বাসি জল খেলে বা সবুজ ঘাসে হাঁটলে ডায়াবেটিসের কিছু উপকার হয়?

☛ উত্তর:  না।

❍ প্রশ্ন:  কিন্তু ডায়াবেটিস রােগীদের তাে নিয়ম করে হাঁটতে বলা হয়?

☛ উত্তর:  শুধু হাঁটা নয়। সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানাে, জগিং, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ বা কিছু আসন নিয়মিত করা দরকার।

❍ প্রশ্ন:  মােটা মানুষদের কি ডায়াবেটিস বেশি হয়?

☛ উত্তর:  হ্যা, তবে ওজন কমিয়ে ফেললে, দ্রুত ফল পাওয়া যায়।

❍ প্রশ্ন:  ডায়াবেটিস কি বংশগত রােগ?

☛ উত্তর:  নন-ইনসুলিন ডিপেনডেন্ট ডায়াবেটিস রােগীদের শতকরা ৫০ জনের পারিবারিক ইতিহাস থাকে।

❍ প্রশ্ন:  বাকিদের?

☛ উত্তর:  অতিরিক্ত ওজন, বেশি খাওয়া বিশেষ করে ঝাল তেল মশলা দেওয়া খাবার এবং ফাস্টফুড, ধূমপান, নিয়মিত ব্যায়াম না করা ইত্যাদি এক বা একাধিক কারণের ফলে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।

❍ প্রশ্ন:  ডায়াবেটিস হলে খাওয়ার ইচ্ছে বেড়ে যায়?

☛ উত্তর:  যাঁরা খেতে ভালবাসেন তাদের যেমন ডায়াবেটিস বেশি হয়, বারবার খিদে পাওয়াও এর অন্যতম উপসর্গ।

❍ প্রশ্ন:  অন্যান্য উপসর্গ কী?

☛ উত্তর:  বারবার তেষ্টা পাওয়া এবং প্রস্রাবের বেগ আসা, দুর্বলত্যু, মাথা ঘােরা, ওজন কমে যাওয়া, ঘা হলে বা কেটে গেলে চট করে না শুকানো, চুলকুনি, হাত-পায়ের পেশির দুর্বলতা, চোখে কমদেখা, সহবাসে অনীহা ইত্যাদি। কখনও আবার কোনও উপসর্গই থাকে না।

❍ প্রশ্ন:  উপসর্গ না থাকলে রোগ বােঝা যাবে কী ভাবে?

☛ উত্তর:  রক্ত পরীক্ষা করে। বাবা মা বা ঘনিষ্ট আত্মীয়দের কারাের ডায়াবেটিস থাকলে অল্পবয়স থেকেই ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম করে যেতে হবে। এবং বয়স ৪০ এর কাছাকাছি এলে বছরে অন্তত একবার রক্তপরীক্ষা করতে হবে।

❍ প্রশ্ন:  রক্তপরীক্ষার রিপাের্ট একেক জায়গায় একেক রকম হয় কেন?

☛ উত্তর:  রিপাের্টের সামান্য হেরফের নানা কারণে হতে পারে। একই ল্যাবরেটরিতে পরপর কয়েকদিন টেস্ট করালে ফাস্টিং ব্লাড সুগারে শতকরা ১০ ভাগ তারতম্য হতে পারে। পিপি ব্লাড সুগার অর্থাৎ পেট ভরে খাওয়ার ২ ঘন্টা পরে যে রক্ত পরীক্ষা হয়, সেখানে শতকরা ২৫-৩০ ভাগ তারতম্য থাকতে পারে। এ নিয়ে অত ভাবনা চিন্তা করার কিছু নেই।

❍ প্রশ্ন:  ডায়াবেটিস আয়ত্তে না থাকলে শরীরের সর্বত্র তার প্রভাব পড়ে?

☛ উত্তর:  হার্ট, কিডনি, চোখ, নার্ভ, চামড়া — অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের প্রভাব পড়ে সর্বত্র। শতকরা ৮০-৮৫ ভাগ ডায়াবেটিস রােগীর মৃত্যু হয় হার্ট অ্যাটাক অথবা স্ট্রোকের দরুন। বাকি ১৫-২০ শতাংশ আক্রান্ত হন কিডনির অসুখে। কারাে ক্ষেত্রে একসঙ্গে একাধিক প্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হয়।

❍ প্রশ্ন:  এই পরিণতি ঠেকিয়ে রাখা যায় না?

☛ উত্তর:  নিয়ম কানুন মেনে চললে অবশ্যই যায়। তবে অনেক সময়ই তা হয় না। কিছু নিয়মকানুন মেনে এবং ওষুধপত্র খেয়ে যে মুহূর্তে সুগার স্বাভাবিক মাত্রায় নেমে আসে অনেকেই তখন চিকিৎসা বন্ধ করে মেথি ভেজানাে জল, নিমপাতার রস, বা উচ্ছে সেদ্ধর উপর নির্ভর করতে শুরু করেন। একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি হতে থাকে বার বার। ফলে তার স্থায়ী প্রভাব পড়ে শরীরে।

❍ প্রশ্ন:  অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে?

☛ উত্তর:  ডায়াবেটিসে কিছু ক্ষেত্রে শরীরের বিভিন্ন স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতি হৃৎপিন্ডের স্নায়ুতে হলে তলে তলে ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ কিছুটা এগিয়ে গেলেও ব্যথা কম হওয়া বা না হওয়ার দরুন অনেক সময় তা ধরা পড়ে না। ফলে ব্যথা বেদনা ছাড়াও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

❍ প্রশ্ন:  কিডনি বাঁচানাের জন্য ডায়াবেটিক রােগীর কিছু বিশেষ সাবধানতা মেনে চলতে হবে।

☛ উত্তর:  হ্যা, বেশ কিছু সাবধানতা মেনে চলতে হবে। যেমন
(১) ডায়াবেটিসের সঙ্গে উচ্চরক্তচাপ থাকলে খুব দ্রুত কিডনি খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা। অতএব রক্তের সুগারের মাত্রা যেমন বাড়তে দেওয়া যাবে না, রক্তচাপও তেমনি বাড়তে না দেওয়া উচিত।
(২) কিডনি আক্রান্ত হওয়ার সামান্যতম সম্ভাবনা বােঝা গেলে খাবারে প্রােটিনের পরিমাণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রতি কেজি ওজনের জন্য ১-০.৫ গ্রাম প্রােটিনই যথেষ্ট।
(৩) শরীরে কোনওরকম সংক্রমণ হলে দ্রুত তা সারিয়ে ফেলার ব্যবস্থা কবতে হবে।
(৪) ব্যথার ওষুধ এবং অ্যান্টিবায়ােটিক খাওয়ার আগে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়া উচিত। কারণ বেশ কিছু ওষুধ আছে যা খেলে কিডনিতে একটু বেশি চাপ পড়ে।
(৫) কিছু এক্সরে এবং সিটিস্ক্যানে কৃত্রিম রঞ্জক ইনজেকশন দিতে হয়। এসব করবার আগে কিডনির কার্যকারিতা দেখে নেওয়া দরকার।

❍ প্রশ্ন:  ডায়াবেটিস থেকে তাে চোখও খারাপ হয়?

☛ উত্তর:  ১০ বছরের ওপর যারা ডায়াবেটিসে ভুগছে তাদের শতকরা ৫০ জনেরই ডায়াবেটিক রেটিনােপ্যাথি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রেটিনার কিছু রক্তবাহী নালি নষ্ট হয়ে গিয়ে ইস্কিমিক মনােনিউরােপ্যাথিরও সূত্রপাত হতে পারে। দুটি ক্ষেত্রেই দৃষ্টিশক্তির ঘাটতি দেখা দেওয়া সম্ভব। অতএব ডায়াবেটিসের রােগীকে নিয়মিত চোখের ডাক্তারের সঙ্গে যােগাযােগ রেখে চলতে হবে। 

Previous Next
No Comments
Add Comment
comment url