রক্তাল্পতার কারণ খুঁজে বার করা খুব জরুরি—চিকিৎসা ও পরামর্শ

কী করে বুঝব রক্তাল্পতা হয়েছে? খুব ধীরে ধীরে রক্তাল্পতা বাড়লে শরীর আস্তে আস্তে মানিয়ে নিতে শুরু শুরু করে। সে ক্ষেত্রে সামান্য বুক ধড়ফড় ও নিঃশ্বাসের কষ্ট ছাড়া আর তেমন কিছু বােঝা যায় না। সাধারণ ভাবে রক্তাল্পতার উপসর্গ বলতে নিঃশ্বাসের কষ্ট, রং ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, দুর্বলতা, ফোলা এবং বুক ধড়ফড় করা। এই বিষয়ে আরো জানাচ্ছেন অধ্যাপক ডাঃ দিলীপ ভট্টাচার্য

❍ প্রশ্ন:  হিমােগ্লোবিন কত হলে বুঝব রক্তাল্পতা হয়েছে? 

☛ উত্তর:  ছেলেদের ক্ষেত্রে ১২ এবং মেয়েদের বেলায় ১১-র নীচে হলে রক্তাল্পতা ধরা হয়। তবে অনেকে আছে ৯-১০ গ্রাম হিমোেগ্লাবিন নিয়েও দিব্যি উপসর্গহীন জীবনযাপন করেন। 

❍ প্রশ্ন:  মহিলারা কি রক্তাল্পতায় বেশি ভােগেন? 

☛ উত্তর:  হ্যাঁ। 

❍ প্রশ্ন:  কেন? 

☛ উত্তর:  মেয়েদের ঋতুস্রাব এবং সন্তান প্রসবের সময় প্রচুর বক্ত শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। ঠিকভাবে তা পূরণ না হলে রক্তাল্পতা হতে পারে। আমাদের দেশের মেয়েদের রক্তাল্পতার আরেকটি বড় কারণ অপুষ্টি। এছাড়া অন্যান্য কারণ তাে আছেই। 

❍ প্রশ্ন:  যেমন? 

☛ উত্তর:  রক্তাল্পতার মূল কারণ নিটি। 
(১) শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে যাওয়া 
(২) শরীরে কম রক্ত তৈরি হওয়া 
(৩) রক্ত তৈরি হলেও, দ্রুত তা খরচ হয়ে যাওয়া মেয়েদের ক্ষেত্রে পিরিয়ড এবং সন্তান জন্মের সময় প্রথমটা আকছার ঘটে। ছেলেদের বেলায় প্রথম কারণটির জন্য রক্তাল্পতা হলে খুব দ্রুত রক্তপাতের উৎস খুঁজে বার করা দরকার। কারণ ডিওডেনাম আলসার বা ক্যান্সার, গ্যাসট্রাইটিস, আলসারেটিভ কোলাইটিস ইত্যাদি রােগ দেরি হলে গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। বাচ্চাদের বেলায় কৃমির জন্যও অনেক সময় আয়রন ডেফিসিয়েন্সি অ্যানিমিয়া দেখা দেয়। শরীরে রক্ত কম তৈরি হয় যদি বােনম্যারাে ঠিকভাবে কাজ না করে বা ভিটামিন বি -১২ ও ফলিক অ্যাসিডের অভাব হয় শরীরে। রক্তসল্পতার তৃতীয় কারণটি দেখা দেয় জেনেটিক কিছু অসুখে। এই তিনটি কারণের জন্য প্রাইমারি রক্তসল্পতা হয়। কখনও অন্য কোনও রােগের পূর্বাভাস হিসেবেও রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে। যেমন, রেনাল ফেইলিওর, ক্যানসার, টিবি, এইডস ইত্যাদি। 

❍ প্রশ্ন:  যে কোনও বয়সেই কি রক্তাল্পতা হতে পারে? 

☛ উত্তর:  হ্যাঁ। 

❍ প্রশ্ন:  বাচ্চার রক্তাল্পতা হয়েছে কীভাবে বোঝা যাবে? 

☛ উত্তর:  বাচ্চা অল্পেই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। পড়াশােনা, খেলাধুলা কোনও কিছুতেই উৎসাহ থাকবে। অল্প অল্প জ্বর হবে। ওজন বাড়বে না। রক্তাল্পতা খুব বেড়ে গেলে হৃদযন্ত্রের গতিও বেড়ে যেতে পারে। 

❍ প্রশ্ন:  বাচ্চার রক্তে হিমােগ্লোবিনের মাত্রা কত হলে বুঝব রক্তাল্পতা হয়েছে? 

☛ উত্তর: ১ থেকে ৬ মাসের শিশুর রক্তে হিমােগ্লোবিন ৯ গ্রামের কম হলে বুঝতে হবে তার রক্তাল্পতা হয়েছে। ৬ মাস থেকে ৪ বছরে ১১ গ্রামের নীচে হলে। 

❍ প্রশ্ন:  কেন হয় এরকম? 

☛ উত্তর:  বাচ্চার খাবারে আয়রণ, ফলিক অ্যাসিড বা ভিটামিন বি-১২-র ঘাটতি হলে রক্তাল্পতা হতে পারে। এছাড়া কোনও অসুখের ফলে নিয়মিত অল্প মাত্রায় রক্তক্ষরণ হলেও রক্তাল্পতা দেখা দেয়। 

❍ প্রশ্ন:  কীভাবে এর সমাধান হবে? 

☛ উত্তর:  বাচ্চার মধ্যে ক্লান্তি, উৎসাহের অভাব দেখলে শিশুরােগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যােগাযােগ করতে হবে। যদি কোনও রােগের কারণে রক্তাল্পতা হয়, তার চিকিৎসা হলেই রক্তাল্পতা সেরে যাবে। এর সঙ্গে প্রচুর আয়রন আছে এমন খাবার দাবার খাওয়াতে হবে বাচ্চাকে। যেমন, ১-৬ মাসের বাচ্চার ক্ষেত্রে গরুর দুধ বা কৌটোর দুধের চেয়ে মায়ের দুধে উপকার হবে বেশি। বড় বাচ্চার ক্ষেত্রে রােজকার খাদ্যতালিকায় ডিম, পাঁঠার মাংস, মেটে, কিডনি, সবুজ পাতাবহুল তরিতরকারি, ছােলা শাক, পালং শাক ইত্যাদির কিছুনা কিছু থাকা উচিত। ফলিক অ্যাসিডযুক্ত খাবার ও ফলিক অ্যাসিড খাওয়ানােরও প্রয়ােজন হতে পারে। ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে নেবেন। 

❍ প্রশ্ন:  গর্ভাবস্থায় রক্তাল্পতা হলে কী করতে হবে? 

☛ উত্তর:  গর্ভাবস্থায় অন্য কোনও জটিলতা ছাড়াই মায়ের রক্তে হিমােগ্লোবিনের পরিমাণ কমে যায়। সমস্যা এড়াতে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। প্রথম হল খাওয়া দাওয়া। সুষম, পুষ্টিকর, আয়রন সমৃদ্ধ খাবার পরিমাণ মতাে খেতে হবে। অনেকের এ সময় বমি বমি ভাব থাকে বা বমি হতে থাকে। দরকার হলে বমি কমানাের ওষুধ খেতে হবে। কিন্তু দিনে ৪-৫ বার খাওয়া বন্ধ করা চলবে না। সকালের খাবারে অন্য জিনিসের সঙ্গে দুধ এবং ডিম যেন থাকে। ১০ টার দিকে টাটকা ফল দুপুরে ডাল, ভাত, সবজির মধ্যে পালংশাক, কাঁচকলা, ঘােড়, ডুমুর, বিনস, গাজর ইত্যাদি, মিড স্যালাড, মাছের ঝােল বা মেটের তরকারি অথবা মুরগি বা খাসির মাংস, বিকেলে অঙ্কুরিত ছােলা, মুগ বা ঘনা। রাত্রে আবার দুপুরের মতাে খাবার খেতে হবে। খাওয়া দাওয়ার সঙ্গে কিছু ওষুধপত্র খাওয়াও জরুবি। আয়রন ডেফিসিয়েন্সি অ্যানিমিয়া ঠেকাতে এসময় দিনে ১০০ মিলিগ্রাম ফেবাস সালফেট ট্যাবলেট খেতে হবে। 

❍ প্রশ্ন:  আয়রন ট্যাবলেট খেলে তাে কোষ্ঠবদ্ধতা হয়? 

☛ উত্তর:  হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ইসবগুলের ভুষি অথবা মিল্ক অফ ম্যাগনেসিয়া খেতে হতে পারে। 

❍ প্রশ্ন:  কিন্তু বেশ কিছু খাবার তাে আছে যা খেলে শরীরে আয়বন পায়। আয়রন ট্যাবলেট খেতে হবে কেন? 

☛ উত্তর:  গর্ভাবস্থায় আয়রনের প্রয়ােজন দিনে ২ মিলিগ্রাম থেকে বেড়ে ৪ মিলিগ্রাম হয়। শেষের দিকে এটা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬ মিলিগ্রামে। খাবার থেকে পুরােমাত্রায় শশাষণ করার পবেও তাই ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ওষুধ খেতে হয় সে জন্যই। 

❍ প্রশ্ন:  ফলিক অ্যাসিডের অভাব থেকেও কি গর্ভাবস্থায় রক্তাল্পতা হতে পারে? 

☛ উত্তর:  আয়রনের মতাে এর চাহিদাও প্রায় ৬ গুণ বেড়ে যায় গর্ভাবস্থায়। নানা কারণে এর ঘাটতি দেখা দিতে পারে শরীরে 
(১) খাদ্যে যদি এর অভাব থাকে 
(২) গর্ভাবস্থায় যদি মা ডায়েবিয়ায় আক্রান্ত হন 
(৩) শরীরে কোনও রােগ সংক্রমণ হলে 
(৪) যমজ সন্তান পেটে থাকলে 
(৫) ফেনিটয়েন জাতীয় কোনও ওষুধ খেলে 

❍ প্রশ্ন:  কুলেখাড়া পাতার রস বা থােড়ের রস খেলে নাকি রক্তাল্পতায় উপকার হয়? 

☛ উত্তর:  জানা নেই। 

❍ প্রশ্ন:  গেঁড়িগুগলি খেলেও শুনেছি রক্তাল্পতা ভাল হয়ে যায়? 

☛ উত্তর:  পেঁড়িগুগলিতে যথেষ্ট পরিমাণে প্রােটিন ভিটামিন রয়েছে। যাদের মাছ, মাংস, ডিম, দুধ খাবার সামর্থ নেই তাঁরা কম খরচে এ থেকে প্রায় সমান উপকার পাবেন। 

❍ প্রশ্ন:  তার মানে মাছ মাংস ডিম দুধ খেলেই সবথেকে উপকার হবে? 

☛ উত্তর:  ব্যাপারটা সে রকম নয়। খাদ্যতালিকায় প্রােটিন ভিটামিন যুক্ত সুষম খাবার থাকা উচিত। মাছ, মাংস, ডিম, ছানা, দুধ যেমন খেতে হবে তেমনই মােচা, ঘােড়, অঙ্কুরিত ছােলা, পালং, কলমি শাক, টাটকা ফল, ডাল ইত্যাদি খেলেও উপকার হবে। 

❍ প্রশ্ন:  দীর্ঘদিন আয়রন ট্যাবলেট খেয়ে গেলে কোনও ক্ষতি আছে কি? 

☛ উত্তর:  শরীরের প্রয়ােজন থাকলে ক্ষতি নেই। তবে অনেকে আছে ক্লান্ত লাগলে বা মাথা ঘুরলে আয়রন খাওয়া শুরু করেন। এটা অনুচিত। কারণ রক্তাল্পতা যদি হয়েও থাকে, কী কারণে হয়েছে সেটা জানা খুব জরুরি। তা না হলে রােগ চাপা পড়ে বিপদ বাধতে পারে। তবে আমাদের দেশে আয়রন ডেফিসিয়েন্সি অ্যানিমিয়াই বেশি হয়। তার চিকিৎসা ভিটামিন, আয়রন বা ফলিক অ্যাসিড এবং সুষম খাদ্য।
Previous Next
No Comments
Add Comment
comment url