বিবাহিত নারীর বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণের চিকিৎসা পরামর্শ

প্রথম সন্তান নষ্ট করলে নাকি বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়? এর উত্তর হলো, সঠিক পদ্ধতিতে অপারেশন না হলে কিছু ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্ব হতে পারে বা গর্ভসঞ্চার হলেও বারবার গর্ভপাত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই বিষয়ে আরো জানাচ্ছেন: ডাঃ সুদর্শন ঘােষ দস্তিদার

❍ প্রশ্ন: আর গর্ভ নিরােধক বড়ি? সে ক্ষেত্রেও তো শুনেছি অনেকের বাচ্চাই হয় না।

☛ উত্তর: না, এ ব্যাপারটা ঠিক এরকম নয়। কিছু ক্ষেত্রে প্রথম দু'এক মাস গর্ভসঞ্চার না হতে পারে। তার কারণ গর্ভ নিরােধক বড়ি ডিম্বাণু তৈরির প্রক্রিয়া সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেয়। ওষুধ বন্ধ করে দেওয়ার পরও ব্যাপারটা স্বাভাবিক হতে কারও ক্ষেত্রে কিছু সময় লাগে। এর মধ্যে শতকরা ৯৮ জন ওষুধপত্র ছাড়াই ঠিক হয়ে যায়, বাকি ২ সামান্য চিকিৎসা দরকার হতে পারে। আসলে সঠিক ভাবে জীবন যাপন করলে এ সমস্ত অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।

❍ প্রশ্ন: সঠিক জীবন যাপন বলতে?

☛ উত্তর: স্বাভাবিক বিবাহিত জীবন; এর সঙ্গে আরও কযেকটা জিনিস খেয়াল রাখা দরকার যেমন মদ্যপান বা ধূমপান যেন মাত্রা না ছাডায়, স্বাস্থ্যসম্মত খাওয়া দাওয়া যাতে অপুষ্টি বা রক্তাল্পতা দেখা না দেয়। ডায়াবেটিস বা রক্তচাপ বেশি থাকলে তা যেন আয়ত্তে থাকে, এবং ওজন না বাড়ে।

❍ প্রশ্ন: ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ থাকলে সন্তান ধারণে অসুবিধে দেখা দেয়?

☛ উত্তর: চিকিৎসার মাধ্যমে রােগ আয়ত্তে থাকলে গর্ভসঞ্চারে তত অসুবিধে থাকে না। কিন্তু এই রােগগুলি আয়ত্তে থাকলেও যেহেতু নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়, গর্ভাবস্থা সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যেতে চাইলে নিয়মিত ডাক্তারের সঙ্গে যােগাযোগ রেখে চলা উচিত। সামান্য অমনযোগেই এদের ক্ষেত্রে গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে।

❍ প্রশ্ন: খুব বেশি মােটা মহিলারাও তাে অনেক সময় বাচ্চা হওয়ার সমস্যায় ভােগেন।

☛ উত্তর: খুব বেশি মােটা যাঁরা, অনেক সময়ই দেখা যায়, তাঁদের কিছু না কিছু রােগ আহে, যার ফলে সন্তান ধারণে অসুবিধে দেখা যাচ্ছে। যেমন হাইপােথাইরয়েডিজম, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ ইত্যাদি। যথাযােগ্য চিকিৎসা এবং সাবধানতার সাহায্যে এদের ক্ষেত্রে খুব সহজেই গর্ভসঞ্চার সম্ভব হয়।

❍ প্রশ্ন: কী রকম?

☛ উত্তর: পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজের কথা বলি প্রথমে। কারণ বন্ধ্যা মহিলাদের শতকরা ১০-১৫ ভাগ এই অসুখে আক্রান্ত। অথচ এই রােগ বােঝা, সাবধান হওয়া এবং চিকিৎসা খুবই সহজ। ১৫-১৮/১৯ বছর বয়সে কোনও মেয়েকে যদি দেখেন হঠাৎ করে মােটা হতে শুরু করেছে, মাঝে মধ্যেই ঋতুচক্রের গণ্ডগােল হচ্ছে এবং অবাঞ্ছিত লােমের উৎপাত হচ্ছে শরীরে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ বা পি সি ও থাকার খুব সম্ভাবনা। এদের চামড়া খসখসে হয়, মুখে ব্রণ থাকে, ঘাড়ে কাঁধে চর্বি জমতে থাকে। যদি দেখা যায় তার বােনেরও একই রকম উপসর্গ আছে তাহলে তাে আর কথাই নেই। সব সময় লক্ষণগুলি একসঙ্গে থাকে না। তবে দুটো থাকলেই মােটামুটিভাবে ধরে নেওয়া যায় রােগটি আছে। সেক্ষেত্রে স্ত্রীরােগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যােগাযােগ করলে বন্ধ্যাত্ব তাে বটেই, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস হৃদরােগ ইত্যদির এড়ানাে সম্ভাবনাও কমে যায়।

❍ প্রশ্ন: এর চিকিৎসা কী?

☛ উত্তর: ওষুধপত্র এবং কিছু সাবধানতা। বছর ২০ আগে অপারেশন দরকার হত। কিন্তু আজকাল এত ভাল ওষুধপত্র বেরিয়ে গেছে যে খুব সামান্য কিছু ক্ষেত্র ছাড়া অপারেশনের আর প্রয়ােজন পড়ে না।

❍ প্রশ্ন: কী কী সাবধানতা মেনে চলতে হবে?

☛ উত্তর: এঁরা যেহেতু খুব মােটা হন এবং সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস থাকে বা থাকার সম্ভাবনা থাকে, খাওয়া দাওয়ার নিয়ন্ত্রণ ও বায়াম খুব জরুরি।
(১) মিস্টি খাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ। কার্বোহাইড্রেট অর্থাৎ ভাত, রুটি, মাটির নীচের সবজি যেমন, কচু, আলু, ইত্যাদি কম খেতে হবে। ঘি, মাখন, চিজ, পাঁঠার মাংস, তৈলাক্ত মাছ, ডিমের কুসুম খাবার তালিকায় কম থাকবে। চকলেট, আইসক্রিম, কোল্ডড্রিঙ্কস, বেশি তেল মশলাদার খাবার না খেলেই ভাল।
(২) ছােট মাছ, চিকেন ডিমের সাদা অংশ খাওয়া যাবে। প্রচুর সবুজ শাক সবজি, গাজর, ঝিঙ্গে, স্যালাড, ডাল, অঙ্কুরিত ছােলা, মুগ, সয়াবিন ইত্যাদি খেতে হবে। এদের প্রচুর ফাইবার খাওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে ভাতের বদলে লাল আটার রুটি, দালিয়া ইত্যাদি খাওয়া যায়।
(৩) খােলা হাওয়ায় হাঁটতে হবে, ব্যায়াম করতে হবে।
(৪) বছরে অন্তত একবার ব্লাড সুগার এবং লিপিড প্রোফাইল টেস্ট করা দরকার।
(৫) নিয়মিত স্ত্রীরােগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যােগাযােগ রেখে চলতে হবে।

❍ প্রশ্ন: হাইপােথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রেও কি এত বিধি নিষেধ?

☛ উত্তর: মােটামুটি প্রায় একই। তবে ওষুধপত্র আলাদা।

❍ প্রশ্ন: যে সমস্ত মহিলা সাদা স্রাবে ভােগেন তাঁদেরও নাকি গর্ভসঞ্চারে অসুবিধে দেখা যায়?

☛ উত্তর: অল্প স্বল্প হলে তেমন অসুবিধে নেই। কিন্তু বেশি সাদা স্রাব হলে এবং এর কারণ যদি হয় পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ বা পি আই ডি, গর্ভসঞ্চারে অসুবিধে শুধু নয় এমন অসুবিধে হবে যে আই ভি এফ ছাড়া তার সমাধান আর হবে না।

❍ প্রশ্ন: সাদা স্রাবের পেছনে পি আই ডি আছে কিনা কী করে বুঝব?

☛ উত্তর: পি আই ডির সমস্যা হচ্ছে অনেক সময়ই উপসর্গ তেমন মারাত্মক হয় না। তাই নজরে আসে না। সাধারণভাবে দুর্গন্ধযুক্ত সাদা স্রাবের সঙ্গে তলপেটে ব্যথা থাকতে পারে। পিরিয়ডের সময় ব্যথা বেড়ে যাবে। মাঝে মাঝে প্রস্রাবের সংক্রমণ হতে পারে। এই পর্যায়ে চিকিৎসা না হলে ব্যথা চলে যায়। তেমন কষ্ট আর থাকে না। কিন্তু তলে তলে বন্ধ্যাত্বের প্রস্তুতি চলতে থাকে। অথচ একটু সচেতন হলে পুরােপুরি এড়িয়ে যাওয়া যায় রােগটিকে।

❍ প্রশ্ন: কী রকম?

☛ উত্তর: অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ থেকেই মূলত রােগটির সৃষ্টি। নােংরা হয়ে থাকা, নােংরা পুকুরে স্নান করা, অপরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরা সর্বোপরি যৌন রােগে আক্রান্ত পুরুষের সঙ্গে সহবাস। রােগের শুরুতে অল্পস্বল্প জ্বালা বা সাদা স্রাবকে গুরুত্ব না দেওয়া, প্রস্রাবের সংক্রমণ হলে সতর্ক না হওয়া ইত্যাদির ফলেই রােগটি থাবা গেড়ে বসে। যার ফলে যেখানে গর্ভসঞ্চার হয় সেই টিউবের মুখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা তার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। টিউব, ওভারি সব মিলেমিশে ডেলা পাকিয়ে যেতে পারে
(টি ও মাস)। অর্থাৎ বন্ধ্যাত্ব। প্রথমেই রােগ ধরা গেলে শুধুমাত্র ওষুধপত্রের সাহায্যে পুরােপুরি সুস্থ করে তােলা যায়।

❍ প্রশ্ন: জরায়ুতে টিউমার থাকলেও কি গর্ভসঞ্চারে অসুবিধে দেখা দেয়?

☛ উত্তর: কিছু ক্ষেত্রে হতে পারে। তবে এর খুব ভাল চিকিৎসা আছে। রােগ ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করালে সমস্যা মিটে যায়।

❍ প্রশ্ন: আজকাল শুনছি জরায়ুর টিউমার অপারেশন না করিয়েও গর্ভসঞ্চার হচ্ছে?

☛ উত্তর: টিউমার, সঙ্গে পেট ব্যথা এবং রক্তপাতের উপসর্গ আছে- আগে অপারেশন না করিয়ে গর্ভসঞ্চারের কথা ভাবাই যেত না। আজকাল কিছু ক্ষেত্রে ওষুধের সাহায্যে টিউমার ছােট করে দেওয়া হচ্ছে। টিউমারের বৃদ্ধিও রােধ করা সম্ভব হচ্ছে। সঙ্গে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা করে গর্ভসঞ্চার করানাে যাচ্ছে।

❍ প্রশ্ন: স্বামীর ডায়াবেটিস থাকলেও নাকি গর্ভসঞ্চারে অসুবিধা হয়?

☛ উত্তর: কিছু ক্ষেত্রে হতে পারে।

❍ প্রশ্ন: চিকিৎসায় এদের সারিয়ে তােলা যায়?

☛ উত্তর: অধিকাংশ ক্ষেত্রে যায়।

❍ প্রশ্ন: রাডার নেক সার্জারি করিয়েও তাে অনেকে অক্ষম হয়ে যান?

☛ উত্তর: অনেকে নয়। খুব সামান্য ক্ষেত্রে অপারেশনের ত্রুটির জন্য এরকম হতে পারে।

❍ প্রশ্ন: পুরুষের ক্ষেত্রে কি এমন কোনও নিয়ম কানুন আছে যা মেনে চললে গর্ভসঞ্চারে কোনও অসুবিধে হবে না?

☛ উত্তর: সাধারণভাবেই মদ্যপান, ধূমপান, অপুষ্টি ইত্যাদি এড়িয়ে চলতে বলা হয়। আর শুক্রাণুর সংখ্যা বা গতিশীলতায় যদি কোনও সমস্যা থাকে দু'একটি নিয়ম কানুন মানতে বলা হয়। যেমন
(১) খাবারের শতকরা ৩০ ভাগ থাকবে স্যালাড। টমেটো, শশা, গাজর, বীট, ধনেপাতা, লেটুস পাতা, অঙ্কুরিত ছােলা, মটর, কপি পাতা-সব মিশিয়ে স্যালাড তৈরি করলে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যাবে। শুক্রাণুর সমস্যা দূর করতে এর ভাল ভূমিকা আছে।
(২) জাঙ্গিয়া খুব টাইট করে পরা যাবে না।
(৩) দিনে দু'তিনবার অন্তত ঠাণ্ডা জলে স্নান করতে হবে।
(৪) সুষম খাবার খেতে হবে। এবং ব্যায়াম করতে হবে নিয়মিত।
(৫) শুক্রাণুর সমস্যা থাকলে নিয়মিত ডাক্তারের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতে হবে ইত্যাদি।

❍ প্রশ্ন: কতদিন অপেক্ষা করার পর বুঝব স্বামী বা স্ত্রী কারর মধ্যে ত্রুটি আছে, ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার?

☛ উত্তর: স্বামী-স্ত্রী যদি স্বাভাবিক জীবন যাপন করেন তবে স্ত্রীর বয়স ২০ থেকে ২৫-এর মধ্যে হলে ২ বছর, ৩০ থেকে ৩৫ হলে ১ বছর এবং ৩৫ এর ওপরে হলে ৬ মাস অপেক্ষা করার পরও যদি গর্ভসঞ্চার না হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

Previous Next
No Comments
Add Comment
comment url