বাচ্চার জ্বর বা অসুখের ডাক্তারি চিকিৎসা পরামর্শ

বাচ্চার জ্বর হলে কী করব? জ্বর ১০১ ডিগ্রির বেশি হলে প্রথমে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাইয়ে জ্বর খানিকটা কমিয়ে নিতে হবে। তারপর ডাক্তারের পরামর্শমতাে চিকিৎসা চালু করবেন। এই বিষয়ে আরো জানাচ্ছেন: ডাঃ ত্রিদীব বন্দ্যোপাধ্যায়

❍ প্রশ্ন: প্যারাসিটামলের শুনেছি নানা রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে?

☛ উত্তর: তেমন কিছু নেই। তাছাড়া বাচ্চার জ্বর বেড়ে গেলে সবথেকে জরুরি কাজ জ্বর কমানো। ঠাণ্ডা জলে স্নান করানাে, মাথা ধুইয়ে দেওয়া বা গা স্পঞ্জ করানাের সঙ্গে সঙ্গে প্যারাসিটামল খাওয়ানােরও দরকার পড়তে পারে।

❍ প্রশ্ন: জ্বরের মধ্যে স্নান করালে বাচ্চার ঠাণ্ডা লেগে যাবে না?

☛ উত্তর: সচরাচর লাগে না। আর লাগলেও বেশি জ্বরে যে ক্ষতি হবে তার তুলনায় সর্দিকাশি সামলানো অনেক সহজ কাজ।

❍ প্রশ্ন: জ্বর হলেই তাে অনেক বাচ্চার তরকা হয়। কী করা উচিত তখন?

☛ উত্তর: তরকা শুরু হওয়ামাত্র বাচ্চার মাথা একদিকে ফিরিয়ে শুইয়ে দিতে হবে, যাতে গাজলা বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে। চামচ বা ওই জাতীয় কিছু মুখে ঢােকানাে উচিত নয়। অবস্থা বুঝে শিরার মাধ্যমে বা রেকটালি ভায়াজিপাম দিতে হতে পারে। এসব সত্ত্বেও ১০ মিনিটের বেশি সময় ধরে তরকা চললে দ্রুত হাসপাতাল বা নার্সিংহােমে নিয়ে যাওয়া দরকার। এর সঙ্গে কয়েকটি সাবধানতা মেনে চলতে হবে। প্রথম, জ্বর বাড়তে না দেওয়া। প্যারাসিটামল বা প্যারাসিটামল আইবুপ্রফেন কবিনেশন হাতের কাছে রাখুন। বাচ্চাকে ঠাণ্ডা জলে মাথা ধুইয়ে, গা মুছিয়ে, দরকার হলে ফ্যানের নিচে শুইয়ে দিতে হবে। বাচ্চা যাতে ঘন ঘন জ্বরজারিতে আক্রান্ত না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

❍ প্রশ্ন: জ্বরের ঘােরে হাত পা খিচতে থাকাই কি তরকা?

☛ উত্তর: তরকা হলে খিচুনি থাকবে। চোখ স্থির হয়ে হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যাবে বাচ্চা। দাঁতে দাঁত লেগে জিভও কেটে যেতে পারে।

❍ প্রশ্ন: বাচ্চা মাঝে মধ্যেই পেটের অসুখে ভােগে, দুর্বল, খেতে চায় না। এসব কি জিয়ার্ডিয়ার উপসর্গঃ

☛ উত্তর: জিয়ার্ডিয়া হলে পেট ব্যথা, বারবার পায়খানার বেগ এবং দুর্গন্ধযুক্ত পায়খানা হবে। বেশিদিন ধরে চলতে থাকলে ম্যালঅ্যাবসরশন সিনড্রোম অথাৎ অপুষ্টিজনিত দুর্বলতা, খেতে ইচ্ছে না করা, রােগা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি নানান উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তবে প্রথম অবস্থাতেই পায়খানা পরীক্ষা করে চিকিৎসা চালু করে দিলে বাচ্চা সম্পূর্ণ ভাল হয়ে যায়।

❍ প্রশ্ন: আমাশাতেও তাে একই ব্যাপার?

☛ উত্তর: আমাশা হলে অবস্থা আরেকটু জটিল হয়। পায়খানার সঙ্গে আম এবং রক্ত থাকতে পারে। দু'ক্ষেত্রেই সাধারণ মল পরীক্ষাতে রােগ ধরা পড়ে। এবং চিকিৎসা চলে মেট্রোনিডাজোল, টিনিডাজোল ইত্যাদির সাহায্যে। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এসমস্ত ওষুধ বাচ্চাকে, খাওয়ানাে উচিত নয়। অনেকে আছেন ঠিকঠাক স্বাস্থ্য-বিধি মেনে চলেন না। ফলে বাচ্চা বারবার জিয়ার্ডিয়াসিস বা অ্যামিবিয়াসিসে আক্রান্ত হয়। এবং মা বাবা মুড়ি মুড়কির মতাে এ সমস্ত ওষুধ খাওয়াতে থাকেন। ফলে বাচ্চার বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, পড়াশােনা সবই বিঘ্নিত হয়।

❍ প্রশ্ন: কী সাবধানতা মেনে চললে বাচ্চাকে আমাশা বা জিয়ার্ডিয়ার হাত থেকে রক্ষা করা যাবে?

☛ উত্তর: এ সমস্ত অসুখের ক্ষেত্রে সবসময়ই অসুবিধে বাধে জল থেকে। খেয়াল রাখতে হবে বাচ্চা যাতে ফোটানাে জল ছাড়া অন্য কোনও জল না খায়। শাকসবজি ভাল করে ধুয়ে তবে রান্নার কাজে ব্যবহার করতে হবে। ফল এবং স্যালাডের ব্যাপারে আরও বেশি সতর্কতা দরকার। খাওয়ার আগে বাচ্চার হাত ভাল করে সাবান দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে।

❍ প্রশ্ন: বমি, পায়খানা, জ্বর ইত্যাদি সব যদি একসঙ্গে হয়?

☛ উত্তর: ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের জন্য এরকম হতে পারে। জ্বর, বমি, পায়খানা শুরু হওয়া মাত্র তিনটি জিনিস চালু করতে হবে। বমি বন্ধ করার জন্য ডমপেরিডন ট্যাবলেট, জ্বর, গা হাত পা ব্যথা সামলাতে প্যারাসিটামল বা প্যারাসিটামল আইবুপ্রফেন কমবিনেশন, এবং পেট খারাপের দরুণ শরীরের জলশূন্যতা রুখতে ওরাল রি হাইড্রেশন থেরাপি। অনেক সময় খুব মারাত্মক পেট ব্যথা থাকে এর সঙ্গে। ব্যথা কমার ওষুধও তখন দেওয়া যেতে পারে। অবস্থা অনেকসময় এতেই সামাল দেওয়া যায়। দরকার হলে অ্যান্টিবায়ােটিক দিতে হবে। তা সত্ত্বেও বাড়াবাড়ি হলে অর্থাৎ উপসর্গ কমছে না এবং সঙ্গে জলশূন্যতা বাড়ছে ধীরে ধীরে, হাসপাতাল বা নার্সিংহােমে নিয়ে যাওয়াই ভাল।

❍ প্রশ্ন: জলশূন্যতা শুরু হচ্ছে কী করে বুঝব?

☛ উত্তর: বমি পায়খানা বন্ধ হচ্ছে না এবং ৪-৬ ঘন্টা বাচ্চা প্রস্রাব না করলে বুঝতে হবে জলশূন্যতা শুরু হতে চলেছে। এর সঙ্গে আরও কয়েকটি উপসর্গ দেখা দেবে। ( ১ ) ক্লান্তি, বাচ্চা চোখ মেলে চাইতে পারছে না। ( ২ ) চামড়ায় সামান্য কোচকানাে ভাব। চামড়া আঙ্গুলে টেনে ছেড়ে দিলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে একটু বেশি সময় লাগবে। নাড়ির গতি, এবং রক্তচাপ কমে যাবে, বাচ্চার বয়স ১ বছরের নীচে হলে মাথার তাল সামান্য বসে যেতে পারে।

❍ প্রশ্ন: পেটের অসুখ চললে বাচ্চাকে দুধ দেওয়া বারণ?

☛ উত্তর: হ্যা, এসময় বাচ্চার দুধ হজম করার ক্ষমতা কমে যায়। অসুখ ঠিক হয়ে যাওয়ার পরও কিছুদিন দুধ বন্ধ রাখা দরকার। ফলের রস কিছুদিন দেবেন না। মুড়ি, চিড়ে সেদ্ধ, গলা ভাত, আলু সেদ্ধ, কাঁচকলা সেদ্ধ, খিচুড়ি বা ছােট মাছের হালকা ঝােল ভাত দেওয়া যেতে পারে। নুন চিনির সরবৎ ঘােল ইত্যাদি সহ্য হলে খাবে। আর খাবে বেশি করে জল।

❍ প্রশ্ন: সর্দি কাশি হলে বাচ্চাকে কাফ সিরাপ খাওয়ানাে যেতে পারে?

☛ উত্তর: খাওয়াতে হতে পারে। তবে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে নেবেন। কারণ কাফ সিরাপ দু’ধরনের। কাফ সিডেটিভ এবং এক্সপেকটোরান্ট। শুকনাে খুসখুসে কাশি কমাতে কাফ সিডেটিভ দেওয়া হয়। আর জমা সর্দি বার করতে এক্সপেকটোরান্ট। বিচারে ভুল হয়ে গেলে বিপত্তি বাধতে পারে।

❍ প্রশ্ন: সব বাচ্চারই তত একবার করে মাম্পস, হাম বা জলবসন্ত হয়। এ সময় কী করা উচিত?

☛ উত্তর: সব বাচ্চারই একবার করে হবে এমন কোনও কথা নেই। যাই হােক, হাম, মাম্পস বা জলবসন্ত সবের ক্ষেত্রেই শরীরে র্যাশ, জ্বর, মাথাব্যথা, সর্দি কাশি ইত্যাদি নানান উপসর্গ থাকে। জ্বর মাথাব্যথা কমাতে প্যারাসিটামল এবং সর্দি কাশির জন্য অ্যান্টিহিস্টামিনিক কিছু খাওয়ানাে যেতে পারে। ২-৩ সপ্তাহ আলাদা করে রাখা দরকার। স্নান বেশি না করাই ভাল। ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। খাবার হওয়া উচিত হাকা সহজ পাচ্য। কিছু ক্ষেত্রে অন্যান্য সংক্রমণ এড়াতে অ্যান্টিবায়ােটিক দিতে হয়।

Previous Next
No Comments
Add Comment
comment url