এক্স-রে বারবার না করানােই ভাল: জেনে রাখুন কারণ গুলো

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম একটি অংশ হলো এক্স-রে। এটির যেমন সুফল পেয়েছি তেমনি একটু হলেও ক্ষতিকর দিক রয়েছে। তাই, এক্স-রে বারবার না করানােই ভাল। এই বিষয়ে আরো জানাচ্ছেন: ডাঃ শংকর রঞ্জন মণ্ডল

❍ প্রশ্ন: বারবার এক্স-রে করালে ক্যান্সার হতে পারে?

☛ উত্তর: হতে পারে। তবে এমন কোনও সােজাসাপটা হিসেব নেই যা থেকে বলা যাবে কতবার পর্যন্ত এক্স-রে করা নিরাপদ। আজকাল এক্স-রে মেশিন অনেক আধুনিক হয়েছে। আগের তুলনায় অনেক কম রশ্মি দিয়ে ভাল মানের এক্স-রে করা যাচ্ছে। এবং এক্স-রের একটা ক্ষতিকর দিক থাকতে পারে সে ব্যাপারে সবাই ওয়াকিবহাল। ফলে নিতান্ত দরকার না পড়লে এক্স-রে করানাে হয় না। বিশেষত পেটের।

❍ প্রশ্ন: কেন পেটের এক্স-রে তে ক্ষতি বেশি হয়?

☛ উত্তর: ক্ষতি হওয়ার প্রশ্ন এখনও আসছে না। এক আধবার কি দশবার এক্স-রে হলেই ক্ষতি হবে এমন নয়। তবে আমরা অকারণ কোনও ঝুঁকি নিতে চাই না। পেটের এক্স রে হলে মেয়েদের ওভারি এবং ছেলেদের টেস্টিস দুটিকেই তার সম্মুখীন হতে হয়। যদি কোন কারণে ডিম্বাণু বা শুক্রাণুর মধ্যে কোনও ত্রুটির জন্ম হয়, তা থেকে ত্রুটিপূর্ণ বাচ্চার জন্ম হওয়া সম্ভব। অথবা বারবার ওই জায়গায় এক্স-রে হতে থাকলে বাচ্চার জন্ম দিতে অক্ষম হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। যদিও এরকম হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

❍ প্রশ্ন: কেন এমন হয়?

☛ উত্তর: এক্স-রে যখন শরীরের মধ্যে দিয়ে যায়, শরীরের কোষের সঙ্গে তার তিন ভাবে সংঘাত হয়।
(১) এক্স-রের কিছু অংশ কোষে শােষিত হয়,
(২) কিছু অংশ ভেদ করে চলে গিয়ে প্লেটে তার ছবি ফুটিয়ে তােলে,
(৩) কিছু অংশ সেখানে থেকে চার ধারে বিক্ষিপ্ত হয়। এক্স-রের যে অংশ কোষের মধ্যে শােষিত হচ্ছে সে কিন্তু কোষে সামান্য পরিমাণ অস্থিবতার জন্ম দিতে পারে। অন্তত তাত্ত্বিকভাবে তাে বটেই দু'চার বার হয়ত কোষ সেই ধাক্কা সহ্য করে নিল, বারবারই পারবে এমন নাও হতে পারে। কোষ ভাঙতে শুরু করতে পারে।

❍ প্রশ্ন: এই জন্যই গর্ভাবস্থায় পেটের এক্স-রে করানাে হয় না?

☛ উত্তর: ঠিক তাই। সূণের মধ্যে কোষ খুব দ্রুতগতিতে বাড়ে। হঠাৎ কোনওটা যদি আক্রান্ত হয়ে পড়ে বুঝতে পারা যাবে না বা তার বৃদ্ধিও বন্ধ করা যাবে না— অসুস্থ বাচ্চার জন্ম হতে পারে।

❍ প্রশ্ন: বুকের এক্স-রে করালেও তাে তার আঁচ খানিকটা পেটে এসে লাগবে?

☛ উত্তর: গর্ভাবস্থায় বুকের এক্স-রে করতে হতে পারে। তখন পেটে এক্স-রে প্রতিরােধী লেড জ্যাকেট জড়িয়ে দেওয়া হয়।

❍ প্রশ্ন: বেরিয়াম মিল এক্স-রে এবং ওরাল কলিসিস্টোগ্রাফি এই দুটি বিশেষ ধরনের এক্স রে নাকি আজকাল মেয়েদের ক্ষেত্রে করা হয় না?

☛ উত্তর: আপার ও লােয়ার জি আই এন্ডােস্কোপি এবং আলট্রাসনােগ্রাফির দৌলতে এই দুটি টেস্টের গুরুত্ব ছেলে বা মেয়ে দুইয়ের ক্ষেত্রেই আগের থেকে কম।

❍ প্রশ্ন: সিটি স্ক্যানেও তাে এক্স-রে ব্যবহার করা হয়। এতে কোনও ক্ষতি হয় না?

☛ উত্তর: এক্স-রের জন্য যতটুকু হওয়ার হবে। তবে সিটি স্ক্যানের একটা সুবিধে আছে, বেশি রশ্মি দেওয়ার প্রয়ােজন হলেও, রশ্মি প্রায় একই জায়গায় থাকে, চতুর্দিকে তেমন বিক্ষিপ্ত হয় না। অথাৎ বুকের সিটি করলে পেটের কোনও প্রত্যঙ্গে রশ্মি এসে লাগার সম্ভাবনা খুব কম।

❍ প্রশ্ন: সিটিতে রশ্মি বেশি লাগে বলছেন। তাহলে পেটের সিটি স্ক্যান করানাের আগে তাে পাঁচবার ভাবা উচিত।

☛ উত্তর: পেটের সিটি স্ক্যান যথেষ্ট ব্যয়বহুল এবং দরকার না পড়লে করনাে হয় না। কাজেই এ নিয়ে চিন্তা করবেন না।

❍ প্রশ্ন: আলট্রাসনােগ্রাফিও তাে শােনা যায় ক্ষতিকর। আজকাল বাচ্চা পেটে এলেই এত বার আলট্রাসনােগ্রাফি করাতে হয় !

☛ উত্তর: তাত্ত্বিক ভাবে আলট্রাসনােগ্রাফির ক্ষতিকর দিক আছে। সেটা হওয়া সম্ভব যদি দিনে ৫-৬ ঘণ্টা ধরে আলট্রাসনােগ্রাফি করা হয় ২-১ সপ্তাহ পর্যন্ত। তবে এই সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে গর্ভস্থ সূণের উপর। পূর্ণ বয়স্ক মানুষের ক্ষতি হতে গেলে অন্তত তার দ্বিগুণ সময় লাগবে।

❍ প্রশ্ন: কিছু এক্স-রে এবং বিভিন্ন ধরনের সিটি স্ক্যানে যে সমস্ত রাসায়নিক রঞ্জক ব্যবহার করা হয়, তারা কি শরীরের ক্ষতি করতে পারে?

☛ উত্তর: দু ধরনের রঞ্জক ব্যবহার করা হয় সি টি স্ক্যানে। তার মধ্যে পুরনাে যেটি, আয়ােনিক রঞ্জক, শিরার মাধ্যমে শরীরে ঢােকালে ২০ হাজার জনের মধ্যে ১ জনের ক্ষেত্রে মারাত্মক শ্বাসকষ্ট বা হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাওয়ার মতাে পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। অধিকাংশ সময় এই রঞ্জকের ক্ষতিকর দিক বলতে শরীরে সামান্য চুলকানি হওয়া। পরবর্তী কালে যে সমস্ত রঞ্জক বেরিয়েছে, নন আয়ােনিক রঞ্জক, তাদের প্রভাবে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আরও অনেক কম।

❍ প্রশ্ন: এম আর আই স্ক্যানে কোনও ক্ষতি হতে পারে?

☛ উত্তর: এম আর আই স্ক্যানের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা এখনও শেষ হয়নি। তবে যতটুকু জানা গেছে ক্ষতিকর প্রভাব তেমন কিছু নেই। এসব ক্ষেত্রে যে সমস্ত রঞ্জক ব্যবহার করা হয়েছে তাদের সম্বন্ধে খারাপ খবর পাওয়া যায়নি। তবে এম আর আই তে রঞ্জকের ব্যবহার একটু কম।

❍ প্রশ্ন: রেডিও আইসােটোপ স্ক্যানে তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করা হয়। তা থেকে কি ক্যান্সার হতে পারে?

☛ উত্তর: আজকালরেডিও আইসােটোপ স্ক্যানে ব্যবহার করা হয় তেজস্ক্রিয় গামা রশ্মি। এর ফলে শরীরে ক্যান্সার হয় না বরং হাড়ের নানা ধরনের ক্যান্সার ধরার কাজে একে ব্যবহার করা হয়।

❍ প্রশ্ন: এত সব পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যাপার একটু কমানাে যায় না? সামান্য হলেও ক্ষতির সম্ভাবনা যখন আছে?

☛ উত্তর: হ্যা কমানাে যেতে পারে যদি ধাপে ধাপে সব কিছু করার ফুরসত ডাক্তারদের মেলে। ধরুন কাবও অবস্ট্রাকটিভ জণ্ডিস হযেছে বলে ডাক্তারের সন্দেহ হল। তিনি যদি মনে কবেন প্রথমে রক্ত পরীক্ষার রিপােট দেখে সন্দেহ দৃঢ় হলে তবে আলট্রাসনোেগ্রাফি করাবেন, এবং তার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে ই আর সি পি বা সি টি স্কান, আজকের দিনে হওযা একটু মুশকিল। কারণ কারও ক্ষেত্রে প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপের মধ্যে দিয়ে গিয়েও রােগ ধবে ফেলা যায়, কারও ক্ষেত্রে একদম শেষ ধাপ পর্যন্ত যেতে হয়। আগে তাে বুঝতে পারা যাবে না কার কোন ধাপে রােগ নির্ণয় হবে। সেক্ষেত্রে হয়তাে এবকম সমালােচনা আসতে পারে সেই তাে ই আর সি পি করাতে হল, প্রথমেই বলে দিলে রােগ তাড়াতাড়ি ধরা পড়ত। বিশেষ করে যদি রােগটা ক্যান্সাব বেরােয়। দু ' এক দিনে যে ক্যান্সারের বিশেষ ক্ষতি হবে না, এবং রােগ নির্ণয় ধাপে ধাপেই হওয়া উচিত, সেটা বােঝাতে চাইলেও বােঝানাে যাবে না। ভাববে ডাক্তার ভুল কবেছে সেজন্য বলছে। আজকাল এত কথায় কথায় ক্রেতা সুরক্ষা আইনের প্রয়ােগ হচ্ছে যে কোন ডাক্তার সাহস করে ওই পথে যাবে বলুন। কাজেই বেশ কিছুদিন ধবে মাথা ব্যথা না সারলে সিটি স্ক্যান করানাে হবে। টেনশন থেকে মাথা ব্যথা হচ্ছে, নাকি মাইগ্রেন থেকে এই ভেবে যদি কোনও ডাক্তার একটুও সময় নষ্ট কবেন এবং পরে সিটি স্ক্যান করে দেখা যায় টিউমার ছিল, যা দিনকাল পড়েছে, খুব সম্ভাবনা আছে ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়ে যাবে। কাজেই মাথা ব্যথা হলে যা যা পরীক্ষা করা দরকার সব প্রেসক্রিপশনে লিখে দিলে যদি বিপদ কম থাকে তাে তাই ভাল।

❍ প্রশ্ন: তার মানে আমাদের উপর বেশি পরীক্ষা নিধীক্ষার বােঝা চাপছে?

☛ উত্তর: আজ না চাপলেও কাল চাপবে। করান না করান প্রেসক্রিপশনে লেখা থাকবে সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করানাের কথা। এবং একবার লেখা থাকলেই দেখবেন আপনি আর না করিয়ে পারছেন না। খরচ বাড়বে। বাড়বে বিপদও। 

Previous Next
No Comments
Add Comment
comment url